ঝর্ণা থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ পানির সঙ্গে হিজল-করচ বনের অপরূপ সৌন্দর্যের দেখা মেলে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে। মূলত ভরা বর্ষায় প্রকৃত রূপ মেলে ধরে এই জলাঞ্চলে। বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই হাওরে বাড়ে পর্যটক। তবে, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার চাপ আরও বেড়েছে । হাউজবোটে চড়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হাওরের মায়াবী সৌন্দর্য উপভোগ করেন পর্যটকরা।
হাওরে ঘুরতে আসা পর্যটকরা জানান, তাদের পরিবার ও বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে এসেছেন তারা। হাওরের সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে তারা জানান, এখানে পরিবেশ খুব সুন্দর। এত সুন্দর জায়গা বাংলাদেশের আর কোথাও নেই বলেও উল্লেখ করেন তারা।
তবে, জেলার পর্যটন ব্যবসা চাঙা হলেও টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য পড়ছে হুমকির মুখে। হাওরে অবাধে ঘুরছে দুইশ'র বেশি হাউজবোট, উচ্চ শব্দে চলছে জেনারেটর, গানবাজনা। চারপাশে পলিথিনের মতো প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকারক নানা বস্তু। এক সময়ে টাঙ্গুয়ার হাওরে যে পাখি কিংবা মাছ দেখা যেত এখন তার ছিটেফোঁটাও নেই। অথচ, টাঙ্গুয়ার হাওরে ট্রলার চালিত নৌকা প্রবেশে ছিলো নিষেধাজ্ঞা। জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ জলাভূমি হিসেবে ঘোষিত টাঙ্গুয়ার হাওর নজরদারির অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে অভিযোগ স্থানীয়দের।
টাঙ্গুয়ার তীরবর্তী মানুষজন অভিযোগ করে জানান, আগে যে পরিমাণ মাছ পানিতে দেখা যেতো তার কিছুই এখন নেই। নানা প্রজাতির মাছ, পাখি এখন বিলুপ্তির পথে। উচ্চ শব্দে সাউন্ডবক্স বাজানোতে এখানকার মানুষজনের সমস্যা হচ্ছে, বাচ্চাদের পড়াশোনার সমস্যা হচ্ছে, যারা হার্টের রোগী তাদের সমস্যা হচ্ছে। পরিবেশেরও ক্ষতি হচ্ছে।
এদিকে, আইইউসিএন ২০১৫ এর সর্বশেষ রেড ডাটা বুকের তথ্য অনুযায়ী, এ হাওরে ১৩৪ প্রজাতির মাছ, ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২১৯ প্রজাতির দেশি ও বিদেশি পরিযায়ী পাখি, ২৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী এবং ১০৪ প্রজাতির উদ্ভিদ থাকলেও বর্তমানে এগুলোর বেশিরভাগই বিলুপ্তির পথে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গেল ১০ বছরে এই হাওরে দেশী ও পরিযায়ী পাখি কমেছে ৭৭ শতাংশ।
উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা জানালেন, টাঙ্গুয়ার হাওরকে বাঁচিয়ে রাখতে পর্যটন নীতিমালায় কিছু পরিবর্তনের চেষ্টা করা হচ্ছে।
আপলিফটমেন্ট সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সালেহীন চৌধুরী শুভ বলেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওরে ভূমি, পানি এবং বায়ু দূষণের সমস্ত কর্মযজ্ঞ সম্পাদিত হয়। উচ্চ শব্দে সাউন্ডবক্স বাজানো হয়। নেচে গেয়ে এটাকে উৎসব সাইটে পরিণত করা হয়েছে যা ইসিওর এবং রামসার সাইটের পরিপন্থী।’
তাহিরপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল হাসেম বলেন, ‘নীতিমালা অনুযায়ী হাউজ বোটগুলোর অবশ্যই তাদের সেফটি থাকতে হবে। যেমন, গ্যাস, ইলেকট্রিক লাইনের সেফটি, পাশাপাশি মানব বর্জ্য কোথায় ফেলবে সেই ব্যবস্থাপনার সিস্টেম থাকতে হবে। কিন্তু এখনো এই সিস্টেম গড়ে উঠেনি। আমাদের জেলা প্রশাসক স্যারের সাথে একটি মিটিং সম্পন্ন হয়েছে। সেসময় তাদের বলা হয়েছে হিউম্যান ওয়েস্ট ডাম্পিং একটি স্টেশন গড়ে তোলার জন্য।’
উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে ঘোষণা করা হয় প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে। এছাড়া, ২০০০ সালের জানুয়ারি মাসে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় রামসার কনভেনশনের আওতায় দেশের ‘রামসার সাইট’ হিসেবে ঘোষণা করা হয় এই হাওরকে।