চব্বিশের ৫ আগস্ট, দুপুরবেলা। বছরের পর বছর নিষ্পেষিত মজলুম জনতার স্রোত গণভবনের প্রাচীরের দিকে এগিয়ে গেলে বালির বাধেঁর মতো ধসে পড়ে, সাড়ে ১৫ বছরের বেশি একচ্ছত্র শাসন করা শেখ হাসিনার মসনদ। ঘটে যায় রক্তাক্ত এক গণঅভ্যুত্থান।
অভ্যুত্থানের পর দেড় হাজারের বেশি ছাত্র-জনতাকে হত্যার ঘটনায় সারাদেশের বিভিন্ন থানায় ও আদালতের দ্বারস্থ হন শতশত, শহিদের পরিবার। তাদের চোখে মুখে ছিল কেবলই বিচার পাবার আকুতি।
একে একে হত্যা ও হত্যা চেষ্টার অভিযোগে, শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতাদের নামে সারাদেশে প্রায় ১ হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ৬ শ’র বেশি হত্যা মামলা। মামলাগুলোতে এখন পর্যন্ত পুলিশের প্রায় ১ হাজার সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। যার মধ্যে অন্তত ৫ জন সাবেক আইজিপি, সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার ৪১ জন, সাবেক ও বর্তমান ডিআইজি ২৪ জন, সাবেক ও বর্তমান এসপি ৬২ জনের নাম পাওয়া যায়। বাকিরা পুলিশের এসআই, এএসআই ও কনস্টেবল।
৫ আগস্টের পর গ্রেপ্তার হন সাবেক দুই আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ও শহীদুল হক। ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও আব্দুল্লাহ হিল কাফিসহ পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্তা। ঢাকার মামলাগুলোতে সবচেয়ে বেশি নাম এসেছে সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলাম, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদ, বিপ্লব কুমার সরকার ও ইকবাল হোসেনের নাম। যারা এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
শহিদ পরিবারের সদস্যরা জানান, প্রশাসন যদি চাপ প্রয়োগ করতো তাহলে হয়তো তারা মামলা নিয়ে কাজ করতো এবং সাজাও হতো কয়েকজনের। আওয়ামী লীগের যে কয়জনকে ধরা হয়েছে তাদের কাউকে দেখে তো মনে হয়না তারা কেউ সাজাপ্রাপ্ত আসামি কিংবা রিমান্ডে আছেন।
এছাড়া প্রায় ৭০ শতাংশ মামলার প্রধান আসামি ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামালসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের প্রায় ১১০ জনের বেশি সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ অসংখ্য নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। যাদের মধ্যে রয়েছে আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, দীপু মনি, রাশেদ খান, হাসানুল হক ইনুসহ এক সময়ের আওয়ামী প্রভাবশালীরা। রয়েছেন সাবেক একাধিক আমলা ও নির্বাচন কমিশনাররাও। তবে জুলাই গণহত্যায় সরাসরি নির্দেশদাতা ও সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িত হিসেবে যাদের নাম মামলায় যুক্ত করা হয়েছে অধিকাংশই গ্রেপ্তার হয়নি। এ নিয়ে ক্ষোভ জুলাই শহিদ স্বজনদের।
শহিদ পরিবারের সদস্যরা জানান, আমরা চাই ড. ইউনূস থাকতেই যেন এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার করে যান। এখনো সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই দেখা যায় আওয়ামী লীগের নেতারা এখনো হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। এদের যদি ধরা না যায় তাহলে আগামীতে আওয়ামী লীগ যদি কোনোভাবে ফিরে আসে তাহলে ২০২৪ এ ২ হাজার শহিদ হয়েছেন, এরপর হয়তো ২ লাখ হবে সংখ্যাটা।
অথচ, এদিকে বিচার শুরুর আগেই জুলাই-আগস্টের ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠছে নানা মহলে। ব্যক্তিগত কিংবা রাজনৈতিক প্রতি-হিংসা বশত জুলাই হত্যার সঙ্গে জড়িত নন এমন মানুষদের নাম যুক্ত করে করা হয়েছে মামলা বাণিজ্য। অধিকাংশ মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবীই বিএনপিপন্থী।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, ‘কিছু লোকের নাম এসেছে। পুলিশ তাদের ধরছে না। আমরাও তাদের ধরতে বলছি না। যাকে আসামি করা হয়েছে সে নির্দোষ। তার কোনো অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাকে তো আর ওই মামলায় আসামি হিসাবে পাঠাবে না।’
জুলাই আগস্টের ঘটনার এক বছরে এসে বিচারিক আদালতে দায়ের করা মামলাগুলোর তদন্ত চলছে ধীরগতিতে। এদিকে ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যায় জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের দায়িত্বে রেখে মামলা তদন্ত করলে তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা আখতার হোসেন।
জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘অভ্যুত্থানের সময় যারা দায়িত্বে থেকে জনগণের পক্ষ না নিয়ে ফ্যাসিবাদের পক্ষে থেকে মানুষের ওপর গুলি চালাতে হুকুম দিলো, যারা সরাসরি গুলি করলো এরকম যারা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীতে আছেন এবং আওয়ামী লীগের কুখ্যাত সন্ত্রাসী নেতারা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এখনো পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গেলো না যে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। এবং শেখ হাসিনার সঙ্গে আরও যারা আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা পলাতক আছেন তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগে সরকারের অগ্রগতি না থাকা আমাদের চূড়ান্তভাবে হতাশ করেছে।’
আরও পড়ুন:
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বচ্ছতা নিশ্চিতে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে, জুলাই আগস্টের মামলা পরিচালনায় করা কথা।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ওমর ফারুক বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কালপ্রিট বাইরে চলে গেছে এবং ছোট খাটো এলাকার যেসব নেতা ছিলো তাদের গ্রেপ্তার করে হয়রানি করা হচ্ছে, বাণিজ্য হচ্ছে। এগুলো আইনের শাসনের জন্য বন্ধ হওয়া দরকার। আমি মনে করি রাজনৈতিক দলগুলো বিচারের বিষয়ে ঐক্যমত্য হয়ে একটি সময় নির্ধারণ করে দিবে কে কোথায় কিভাবে সহযোগিতা করবে এবং সাক্ষী সরবরাহের জন্য একটা টাস্কফোর্স গঠন করার মধ্য দিয়ে এ কাজ করবে বলে আমি মনে করি।’
সব মিলিয়ে বাস্তবতা এটাই জুলাই আগস্টের ঘটনায় এখনো মামলা হচ্ছে বিচারিক আদালতে। মামলাগুলোতে কতজন তদন্তকারী কর্মকর্তা কাজ করছে তারও সঠিক হিসেব নেই। এমন পরিস্থিতিতে বিচার নিশ্চিতে সরকারকে আরও মনোযোগী হওয়ার তাগিদ জানান শহিদ পরিবারগুলো।