প্রায় দুই দশক আগে বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের যাত্রা শুরু হলেও পিছিয়ে ছিল প্রযুক্তিগত দিক ও জনপ্রিয়তায়। স্থাপন খরচ বেশি, সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য আলাদা যন্ত্রপাতি প্রয়োজনসহ বিভিন্ন কারণে সোলারের চেয়ে আইপিএস ব্যবহারেই আগ্রহী সাধারণ ব্যবহারকারীরা। তবে গত ৩ থেকে ৪ বছরের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎসটি।
দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার ব্যবসায়ী প্রিন্স মন্ডল নিজের বাড়িতে সোলার ব্যবহার করছেন বেশ কিছুদিন থেকে। সম্প্রতি খামারেও একই প্রযুক্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহার করছেন। বিদ্যুৎ বিল সাশ্রয়ের পাশাপাশি গ্রিন এনার্জির কারণেও তার এই সিদ্ধান্ত। তার মতো অনেকেই এখন বিদ্যুতের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাচ্ছেন সৌরশক্তির ব্যবহার করে। পাশাপাশি এ খাতে দক্ষতা বেড়েছে ইলেক্ট্রিশিয়ানদের।
স্থানীয়দের মধ্যে একজন বলেন, ‘সোলারের দিকে আগ্রহী হলাম, এর প্রথম উদ্দেশ্য হলো বিদ্যুৎ সাশ্রয়। আরেকটা কারণ হলো এটা পরিবেশবান্ধব।’
ইলেক্ট্রিশিয়ান ও সোলার এক্সপার্ট মো. রোকন মিয়া বলেন, ‘একটা ভালো মানের আইপিএস স্থাপন করতে গেলে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লাগে। আর আপনি এই সমপরিমাণ টাকার খরচে সোলার প্যানেল স্থাপন করতে পারছেন, দিনেও আপনার বিদ্যুৎ বিল আসছে না।’
সরকারের নেট মিটারিং পদ্ধতি চালুর ফলে সোলার দিয়ে এখন শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনই নয়, পাশাপাশি উৎপাদিত অতিরিক্ত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে বিক্রিরও সুযোগ রয়েছে। তাই বাসা-বাড়ি, কলকারখানায় পরিকল্পনা অনুযায়ী সোলার স্থাপন করতে পারলে বিদ্যুৎ বিল তো দিতে হবেই না, উল্টো সরকারের কাছ থেকে আয় করা সম্ভব। সারা মাসে সোলার থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ গ্রিডে দেয়ার পরিমাণ যদি গ্রিড থেকে ব্যবহারের চেয়ে বেশি হয় সেক্ষেত্রে পরবর্তী মাসের বিলের সাথে সমন্বয় করা হয়। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সরবরাহকারীকে প্রতি ইউনিট সাড়ে ৬ টাকার কিছু বেশি দর দেবে ডিপিডিসি।
তবে এখন পর্যন্ত থ্রি ফেজের সংযোগের বিপরীতে দেয়া হচ্ছে নেট মিটারিং সুবিধা। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের পর্যাপ্ত প্রচার ও থ্রি ফেজের পাশাপাশি সিঙ্গেল ফেজেও এই সুবিধা দিলে ব্যক্তি উদ্যোগে সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনের আগ্রহ আরো বাড়বে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. জাকিউর রহমান বলেন, ‘নেট জিরো কার্বনের দিকেও যদি আমরা যেতে চাই, সেক্ষেত্র আমাদের সোলার পাওয়ার ব্যবহারের বিকল্প নেই। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের কার্বন ফুটপ্রিন্টও কমিয়ে আনতে পারি। আমি বিশ্বাস করি, আমরা যদি সুবিধাটা সবার সামনে তুলে ধরতে পারি তাহলে অবশ্যই আগ্রহী হবে।’
বাংলাদেশে বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে গড়ে ৩৪০ দিন সূর্যের আলো থাকে। গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহারের কারণে বছরে এক লাখ ৪০ হাজার টন কেরোসিন সাশ্রয় হচ্ছে, যার বাজার মূল্য প্রায় ১২০ মিলিয়ন ডলার। তাই সোলারের ব্যবহার বাড়ানো গেলে শুধু পরিবেশই রক্ষা হবে না, সাশ্রয় হবে বৈদেশিক মুদ্রাও।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন বিশ্লেষক ও সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক বলেন, ‘কয়লা বা তেল আমদানি করে আমরা যে বিদ্যুৎ উৎপাদন কাজে ব্যবহার করছি, এটি আমাদের অর্থনীতির ওপর একটা বড় ধরনের চাপ তৈরি করছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা এবং আমাদের অর্থনৈতিক ভারসাম্যের জন্য, আমদানি ব্যয় কমানোর জন্য এই সৌর শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে যাওয়াটা খুব জরুরি।’
সাধারণত একটি সোলার প্যানেলের আয়ুষ্কাল ২০ থেকে ২৫ বছর। ব্যাটারি ও ইনভার্টার মানভেদে দুই থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। তাই সোলার স্থাপনে প্রাথমিক খরচ বেশি হলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি অনেক বেশি সাশ্রয়ী। সাধারণ গ্রিডের বিদ্যুতের মতোই সোলার দিয়ে সব ধরনের বিদ্যুৎচালিত যন্ত্র ব্যবহার করা সম্ভব।
২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ প্রায় ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি বিদ্যুৎ আসবে সূর্যের আলো থেকে, অর্থাৎ সোলার পাওয়ার। আর শুধু বড় বড় প্রকল্পই নয়, এই বিপ্লবে অংশ নিতে পারেন আপনিও। আপনার ছাদ হতে পারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘর এবং সেই সঙ্গে আয়ের উৎসও। রুফটপ সোলার প্রযুক্তির মাধ্যমে এখন দেশের অনেকেই নিজেদের বিদ্যুৎ চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করে উপার্জন করছেন অর্থ। নবায়নযোগ্য শক্তির এই যাত্রায় একসাথে এগিয়ে গেলে, আমরা গড়তে পারি এক টেকসই, সবুজ, আর স্বাধীন জ্বালানিনির্ভর বাংলাদেশ।