জুলাই গণঅভ্যুত্থান: শিক্ষক-আইনজীবী-সংস্কৃতিকর্মীরা রাখেন যুগান্তকারী ভূমিকা

জুলাই আন্দোলনে নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষকদের ব্যানারে ছাত্রদের পক্ষে র‍্যালী
জুলাই আন্দোলনে নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষকদের ব্যানারে ছাত্রদের পক্ষে র‍্যালী | ছবি: এখন টিভি
0

মধ্য জুলাই থেকে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার লড়াইয়ে শামিল হন শিক্ষক-আইনজীবী-সংস্কৃতি কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। যাদের বিচরণ শ্রেণীকক্ষে, অভিনয়ের মঞ্চে কিংবা আদালতে। ছাত্রদের পক্ষে তাদের উচ্চারিত কণ্ঠ রূপ দেয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন হয় ফ্যাসিস্ট সরকারের। কিন্তু ছাত্র-জনতার পক্ষে দাঁড়ানোর দিনগুলো এইসব পেশাজীবীদের জন্য কতটা মসৃণ ছিলো?

আগস্টের প্রথম দিন। জেন জি-দের ভাষায় তা জুলাই মাসের ৩২তম দিন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রাণহানির সংখ্যা তখন হাজারের কাছাকাছি। এরকম সময়েই বিটিভি ভবনে শিল্পী সমাজের কয়েকজন তারকার প্রতিবাদী মানববন্ধন। তবে, প্রাণহানি নয়, বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার হামলায় পুড়ে যাওয়া বিটিভি ভবনের জন্যই তাদের এই হাহাকার।

একইদিন ফার্মগেটে ভিন্ন দৃশ্য দেখে দেশবাসী। সেদিন শিল্পী সমাজের এক অংশ ফার্মগেটে অবস্থান নেন ছাত্রসমাজের পক্ষে।

আজমেরী হক বাঁধন বলেন, ‘ওই শিশুদের মাঝে আমার সন্তান থাকতে পারতো। ওই মানুষগুলোর মাঝে আমি আপনিও থাকতে পারতাম।’

একদিকে ছিলো সরকারের নানা প্রলোভন, ছিলো আন্দোলনে অংশ না নিতে গোয়েন্দা বাহিনীর চাপ। সব উপেক্ষা করে কতটা সহজ ছিলো ছাত্রদের পক্ষে দাঁড়ানো?

বাঁধন বলেন, ‘হেলিকপ্টার থেকে যখন রিয়া গোপকে শ্যুট করা হলো আর কিছুদিন পর যখন রিয়া গোপ মারা গেলো, তখন আমার মনে হলো আমার কিছু একটা করা উচিত। আমার নিজেরও একটা মেয়ে আছে।’

উনসত্তরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক শামসুজ্জোহাকে প্রাণ দিতে হয় ছাত্রদের পক্ষ নেয়ায়। গণঅভ্যুত্থানে অধ্যাপক শামসুজ্জোহার সেই সাহসিকতার প্রতিচ্ছবি দেখা যায় চব্বিশেও। নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষকদের ব্যানারে, জুলাইয়ের শুরু থেকেই তাদের প্রতিবাদী ভূমিকা আলো-ছায়া দেয় শিক্ষার্থীদের।

কোটা সংস্কারের দাবিতে, ২০১৮ সালেও রাজপথে নেমেছিলো শিক্ষার্থীরা। সেবার আন্দোলন শুরু হয় একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে। আর চব্বিশের আন্দোলন শুরু হয় দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর। নির্বাচনের পরে আন্দোলন গড়ে ওঠায় সেই আন্দোলন দমনপীড়নে কোনো পিছুটান রাখেনি আওয়ামী লীগ সরকার। এমন অভিমত আন্দোলনে অংশ নেয়া এই শিক্ষকের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা বলেন, ‘আমাদের সবসময় ধারণা ছিলো আমরা যদি এখনি কিছু না বলি তাহলে তারা হয়তো আরও খারাপ করবে। আরও খারাপ যেন তারা না করেন, তাদের হত্যাকাণ্ডগুলো যেন বৈধতা না পেয়ে যায় সেজন্য আমরা এগিয়ে এসেছিলাম। তখন আমাদের ভয় লাগেনি। আমাদের শুধু মনে হয়েছে আমাদের সামনে যেতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, ‘যখন দেখি ছাত্ররা অকাতরে জীবন দিচ্ছে, তখন ঘরে বসে থাকা মানে অন্যায় করা। সুতরাং রাস্তায় নেমে আসা মানে এমন না আমাকে কিছু পেতে হবে। সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বে, নিজের সচেতনতা বোধ থেকে সামনে এসেছি।’

জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে আন্দোলন দমাতে কঠোর রূপ দেখায় সরকার। ছাত্র-জনতার মিছিলে নির্বিচারে গুলিতে যখন ঘটছিলো জীবনের নিদারুণ অপচয়, সে সময় ত্রাতা হয়ে আসেন আইনজীবীদের কয়েকজন। বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি না ছুড়তে, ২৯ জুলাই মাত্র আধা ঘণ্টায় পিটিশন ড্রাফট করে আদালতে রিট করেন তারা। ডিবি অফিসে আটক থাকা ৬ সমন্বয়কের মুক্তির বিষয়টিও ছিলো রিটে।

আইনজীবী ও গণমাধ্যমকর্মী মানজুর আল মতিন বলেন, ‘বাঁচা মরাটা খুব বড় বিষয় ছিলো না। সেসময় আসলে ওঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করাটাই একমাত্র রাস্তা খোলা ছিলো সামনে। যেভাবে স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদেরকে মারা হচ্ছিলো, যেভাবে নিজ বাড়িতে রিয়া গোপকে হত্যা করা হলো তখন ঘরে বসে থাকাটা আমাদের সামনে আর অপশন বলে মনে হয়নি।’

অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে, পাওয়া-না পাওয়ার খতিয়ানে বেশ অমিল থাকলেও, ছাত্র-জনতার পক্ষ নেয়াই তাদের জীবনের উত্তম সিদ্ধান্ত বলেই মনে করেন তারা।


ইএ