উপকূলীয় নদ-নদীতে নির্বিচারে চলছে রেণু শিকার। এ কাজে মশারি জাল ব্যবহারের কারণে প্রতিদিনই ধ্বংস হচ্ছে নানা প্রজাতির মাছের লার্ভা, ডিমসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী।
বরগুনার নদীর তীরবর্তী এলাকা ঘুরে দেখা যায় রেণু শিকারিদের বেশিরভাগই শিশু-কিশোর। যাদের অনেকেই সিন্ডিকেটের দেয়া দাদনের দুষ্টচক্রে আটকে পড়ছেন। মৎস্য বিশেষজ্ঞরা জানান, সিন্ডিকেট বন্ধ হলে মিলবে সুফল।
রেণু শিকারিদের মধ্যে একজন বলেন, ‘আমরা তো গরিব মানুষ, এজন্য দাদন নিয়ে আমরা এগুলো করি।’
আরেকজন বলেন, ‘মাছ চালান না দিলেই এটা বন্ধ হয়ে যাবে। আর চালান দিলে আমরা মাছ বেচতে পারবো, তা না হলে পারবো না।’
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সাজেদুল হক বলেন, ‘ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে যারা চাইল্ড লেবারের মধ্যে পড়বে এবং মহিলাদের কম পারিশ্রমিক দিয়ে রেণু শিকারের প্রলোভন দিয়ে থাকে। আমাদের মৎস্য অধিদপ্তরসহ অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে সঠিকভাবে তদারকি করে এই চক্রকে ভাঙতে হবে।’
কয়েক ধাপে এই সিন্ডিকেটের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। প্রথমে শিকারিদের কাছ থেকে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় বাগদা ও গলদা রেণু কিনে মহাজনের কাছে বিক্রি করেন হকাররা, এরপর পাইকাররা বাড়তি দরে মহাজনদের গদি থেকে রেণু কিনে সরবরাহ করেন মোকামে।
অবৈধ রেণু শিকারিদের ঠেকাতে অভিযানে নেমে হামলার শিকার হতে হয় মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তাদের। যার নেপথ্যে থাকে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট।
বরগুনা জেলার মৎস্য কর্মকর্তা মো. মহসীন বলেন, ‘এদের মধ্যে পুরুষ-মহিলা সবাই থাকে। তাদের বিরুদ্ধে সবসময় ১০০ ভাগ আইন প্রয়োগ করা মুশকিল হয়ে পড়ে। আমাদের লোকবল স্বল্পতা এর জন্য একটা বাধা।’
সদরের লতাকাটা খেয়াঘাটে হাতে নাতে ধরা পড়ে সিন্ডিকেটের সদস্য। এসময় ২৫ হাজারের মতো রেণু মৎস্য বিভাগের নির্দেশনায় অবমুক্ত করা হয়।
জেলার সবচেয়ে বড় মোকামের খোঁজে পাথরঘাটায় যাওয়ার পথেই দেখা যায় মোটর সাইকেলে করে রেণু সরবরাহ করছে সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য। তাকে থামানো হলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই হাজির হন চরদুয়ানীর সিন্ডিকেটের হোতারা।
অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, বরগুনায় প্রায় ৩০টির বেশি গদি রয়েছে। আমতলীর পচাকোড়ালিয়ার জালাল, বগীর মো. মতি, নলী এলাকার রহমান সহ তালতলী উপজেলা, বামনায় প্রভাবশালীরা গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। অন্যদিকে সদরের ফুলঝুরি এলাকায় ঘরে ঘরেই চলে অবাধে রেণু বেচাকেনার কার্যক্রম।
বরগুনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আবদুল হালিম বলেন, ‘ভালো হলো যে এটা আমরা জানতে পেরেছি। এবার এটা পরিবহনের সাথে কারা জড়িত বা টোটাল সিন্ডিকেটের সাথে কারা জড়িত আছে সেগুলো যাচাই বাছাই করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সিন্ডিকেট চক্র বরগুনা থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ রেণু পিরোজপুরের রুট ব্যবহার করে পাঠিয়ে দেয় খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে। এসব রুটে নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি পদক্ষেপের কথা জানান মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ‘যারা পাচার করে এবং যারা অবৈধভাবে ধরে, এমনকি যারা অবৈধ জাল ব্যবহার করে, তাদেরকে আমরা কঠোরভাবে দমন করতে চাই।
রেণু শিকার বন্ধে প্রশাসন সবসময় থাকে কঠোর অবস্থানে। তবুও সিন্ডিকেটের দুষ্টচক্রে কখনোই বন্ধ হয় না রেণু শিকার, যা দেশের সামগ্রিক মৎস্য-খাতের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই মৎস্য গবেষক এবং সচেতন মহল বলছেন, প্রান্তিক পর্যায়ে শিকারিদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে রেণু সিন্ডিকেট।