২০২৩ সালে দালালদের মিথ্যা প্রলোভনে সাগর ও তানজির প্রত্যেকে ৪ লাখ টাকা খরচ করে লিবিয়ায় যান। আলমগীর বিদেশ গিয়েছিলেন আড়াই বছর আগে ৩ লাখ টাকা খরচ করে।
দালালরা তাদের ইতালিতে চাকরি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে লিবিয়া পাঠিয়েছিল। সেখানে পৌঁছানোর পরে পাচারকারীরা তাদেরকে ভয়ংকর এক মাফিয়া চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয়।
ত্রিপোলিতে আরও ৮০ জন বাংলাদেশির সঙ্গে আটকে রেখে তাদের ওপর চালানো হয় মাসের পর মাস নির্মম নির্যাতন। পরিবারের কাছ থেকে নেওয়া হয় মুক্তিপণ। একসময় তারা মারা গেছেন এটা ভেবে পাচারকারীরা তাদের মরুভূমিতে ফেলে রেখে চলে যায়।
সেখান থেকে তাদেরকে মৃতপ্রায় অবস্থায় কয়েকজন বাংলাদেশি শ্রমিক খুঁজে পান এবং আশ্রয় ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। আজ সকালে লিবিয়া দূতাবাস ও আইওএমের সহায়তায় দেশে ফিরেছেন লিবিয়ায় আটকে পড়া ১৪১ জন বাংলাদেশি। তাদের মধ্যে ছিলেন সাগর, তানজির ও আলমগীরও।
এদিকে লিবিয়ায় আটকে থাকা তিন বাংলাদেশির পরিবার তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্যে যোগাযোগ করে ব্র্যাকের সঙ্গে। পরিবারের আবেদনের ভিত্তিতে ব্র্যাক, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ট্রাফিকিং ইন পারসনস (টিআইপি) অফিস, ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) এর ওয়াশিংটনের দপ্তর এবং ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিস মিশন (আইজেএম) এর সমন্বিত প্রচেষ্টায় এ তিন তরুণকে লিবিয়ায় সেইফ হোমে স্থানান্তর করা হয়।
আইনি জটিলতা কাটিয়ে এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের প্রত্যাবাসন সম্পন্ন হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড, ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) এর লিবিয়া মিশন এবং লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
এ ঘটনায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে ঢাকায় পৃথক দু’টি মামলা দায়ের হয়েছে যার মধ্যে একটির তদন্ত পরিচালনা করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে দুই মানব পাচারকারী।
মানব পাচারের শিকার তানজির শেখ বলেন, ‘লিবিয়ায় আমাদেরকে দিনের পর দিন বেঁধে রাখতো, লোহার রড দিয়ে পেটাতো। নির্যাতনের ভিডিও আমাদের পরিবারকে পাঠিয়ে মুক্তিপণ নিয়েছে। মারা গেছি ভেবে তারা আমাদের মরুভূমিতে ফেলে রেখে গিয়েছিল। বেঁচে কোনোদিন যে দেশে ফিরতে পারবো সেটা ভাবিনি।’
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম এন্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) শরিফুল হাসান বলেন, ‘ইউরোপে পাঠানোর লোভ দেখিয়ে যাদের লিবিয়া নেওয়া হয় তাদের সবাইকে ইতালিতে ভালো চাকরির কথা বললেও তারা কিন্তু চাকরি পায় না। উল্টো অধিকাংশকেই লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দি রেখে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। এরপর তাদেরকে জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হয়। তবে এতো কিছুর পরেও ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে বাংলাদেশের মানুষের ইউরোপের স্বপ্নে লিবিয়া যাওয়ার এ প্রবণতা থামছে না।’
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারের ম্যানেজার আল আমিন নয়ন বলেন, ‘তিন বাংলাদেশি মানব পাচার সার্ভাইভারের প্রত্যাবাসনের জন্যে আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাফিকিং-ইন-পারসন্স হিরো নেটওয়ার্কের সহায়তা নিয়েছি। গত মাসের ২৫ জুন মানব পাচারের শিকার আরও দুই জন বাংলাদেশিকে ব্র্যাক ও টিআইপি হিরো নেটওয়ার্কের সহায়তায় দেশে ফিরিয়ে এনেছে।’
বিমানবন্দরের বিদেশ-ফেরতদের জরুরি সহায়তায় দিতে গত আট বছর ধরে কাজ করছে ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টার। সিভিলে এভিয়েশন, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক, এপিবিএনসহ সবার সহযোগিতায় গত আট বছরে ৩৭ হাজারেরও বেশি মানুষকে নানা ধরনের সহযোগিতা করা হয়েছে। শুধু ২০২৪ সালেই ৪০ জন প্রবাসীকে বিশ্বের নানা দেশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।