২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির আওতায় জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর মাত্রা নিয়ে যে চুক্তিতে পৌঁছায় উন্নত দেশগুলো, পরবর্তী ৯ বছরে চুক্তির কোনো শর্তই কার্যত বাস্তবায়ন হতে দেখেনি বিশ্ববাসী। বরং গেল বছর গোটা বিশ্বের গড় উষ্ণতা বেড়েছে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি। যা শিল্প বিপ্লব পূর্ববর্তী সময়ের চেয়েও বেশি। আর ২০২৫ এর জুনে এসে উষ্ণতম মাসের রেকর্ড গড়ে ফেলেছে পর্তুগাল ও স্পেন। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই দ্বিতীয় তাপপ্রবাহের আশঙ্কা ভাবাচ্ছে দক্ষিণ ইউরোপের বাসিন্দাদের।
ইউরোপজুড়ে যখন পরিস্থিতি ক্রমশই উদ্বেগ বাড়াচ্ছে, ঠিক তখন ৭ দিন ধরে দাবানলে পুড়ছে তুরস্কের পশ্চিমাঞ্চল। একই পরিস্থিতি গ্রিসের দক্ষিণেও। গেল জানুয়ারি থেকে বিজ্ঞানীরাও আভাস দিচ্ছিলেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বিশ্ববাসীর সামনে দাবদাহের পর দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হয়ে আসবে দাবানল। যার কিছুটা নজির দেখা গেছে গেল জানুয়ারিতেই। যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে ভয়াবহ দাবানলে পুড়ে যাওয়া ১২ হাজারের বেশি অবকাঠামো আর কয়েক ডজন মানুষের প্রাণহানি সাক্ষ দিচ্ছে দাবানল নিয়ে হেলাফেলার আর সুযোগ নেই বিশ্ববাসীর সামনে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের তথ্য বলছে, ইউরোপে ১০টির মধ্যে ৯টি দাবানল মানবসৃষ্ট কারণে ঘটলেও শুষ্ক আবহাওয়া এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবকের কাজ করে। জলবায়ু বিজ্ঞানীরাও দাবি করছেন, শুষ্ক মৌসুমে ইউরোপে যে দাবদাহ দেখা যাচ্ছে তা মূলত হিট ডোমের কারণে। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো ও গাছ কেটে ফেলার কারণে ভূপৃষ্ঠে যে তাপের বলয় সৃষ্টি হচ্ছে, তার প্রভাবেই নির্দিষ্ট সময়ের আগেই শুরু হচ্ছে তাপপ্রবাহ। ফলে, বিস্তীর্ণ বনভূমিতে আগুন একবার ছড়িয়ে পড়লে তা আর নিয়ন্ত্রণে করা যাচ্ছে না।
জলবায়ু বিজ্ঞানী ক্রিস্টি ম্যাকাবে বলেন, ‘দক্ষিণ ইউরোপ জুড়ে যে দাবদাহ চলছে তার মূলে হিট ডোম। পাশাপাশি বাতাসের চাপ থাকায় অঞ্চলটিতে আটকা পড়ছে উষ্ণ এই আবহাওয়া। উচ্চতাপের কারণে বাতাসও ক্রমাগত নিচু অঞ্চল দিয়ে বইছে। সৃষ্টি হচ্ছে না মেঘ। দেখা যাচ্ছে না ঝড় বাদলও। এর অর্থ আরও উষ্ণতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ইউরোপ, বাড়ছে দাবানলের আশঙ্কাও।’
জলবায়ু বিজ্ঞানী এরিচ ফিসচার বলেন, ‘আমরা যে বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে রয়েছি, সেখানে বায়ুমণ্ডলের তাপ যেমন বাড়ছে তেমনি সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতাও বাড়ছে। এতে করে বায়ুমণ্ডলের আদ্রতাও বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। এইসব কিছু মিলেই তীব্র তাপপ্রবাহ সৃষ্টি হয়। শুধু তাই নয় বিপজ্জনক এই দাবদাহ বারবার ফিরে আসার আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে।’
গেল বছরে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ভুগিয়েছে বিশ্ববাসীকে। ইতালি ও দক্ষিণ আমেরিকায় তীব্র খরা, নেপাল, সুদান ও ইউরোপে মারাত্মক বন্যা, মেক্সিকো, মালি ও সৌদি আরবে দাবদাহে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি, আর যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিপিন্সে আঘাত হানে ভয়াবহ সাইক্লোন। এই সবকিছুর মূলেই আছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি। তবে, এই উষ্ণতম পৃথিবীতে মানবসৃষ্ট দাবানল যে আগামী দিনের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের একটি হতে চলেছে, এ নিয়ে দ্বিমত নেই বিজ্ঞানীদের।