বিশ্ব থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথে রাশিয়া। এ প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১১ সালে, যখন অনলাইনে সরকারবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। রাজনৈতিক অস্থিরতা দমাতে ধাপে ধাপে ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে নানা ব্যবস্থা নেন পুতিন। ওয়েবসাইট ব্লক, ব্যবহারকারীর তথ্য সরকারের হাতে রাখা, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাপ নিষিদ্ধ করা হয়।
২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এ নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর হয়। একযোগে নিষিদ্ধ করা হয় ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম। ধীরগতি করা হয় ইউটিউব। মোবাইল ইন্টারনেটও বন্ধ রাখা হয় অনেকদিন। সবই দেশটির সরকারের কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ। এতে বিপাকে পড়েন দেশটির ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা।
স্থানীয়দের মধ্যে একজন বলেন, ‘আইনটি পরস্পরবিরোধী। যদি ভুলবশত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে কেউ উগ্রপন্থী ওয়েবসাইটে প্রবেশ করেন, তাহলে তার দোষ কী?’
অন্য একজন বলেন, ‘বিভিন্ন অ্যাপ নিষিদ্ধ করার বিষয়টি দুঃখজনক। আমার মতো সাধারণ ব্যবহারকারীরা এতে বিপাকে পড়বেন।’
রাশিয়ার একজন বলেন, ‘ভিপিএন বন্ধে খুব একটা প্রভাব না পড়লেও, হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধ হলে অনেকেই বিপদে পড়বেন। এসব অ্যাপস অনেকের জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে।’
অন্য একজন বলেন, ‘বিকল্প হিসেবে অনেক মেসেজিং অ্যাপ চালু হবে। কিন্তু সেগুলোতে বাসিন্দারা কতটুকু অভ্যস্ত হবে সেটি একটি বড় প্রশ্ন।’
তবে ক্রেমলিন বলেছে, ইউক্রেনের হুমকি মোকাবিলায় রাশিয়াজুড়ে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করা জরুরি ছিল। ইউক্রেনের ড্রোন হামলা ব্যাহত করতেই ইন্টারনেট বিভ্রাট তৈরি করা হয় বলে জানান ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ।
তিনি বলেন, ‘রাশিয়ার হুমকি ও নাগরিকদের নিরাপত্তায় যেকোনো পদক্ষেপ নিতে পারে সরকার। দেশের নিরাপত্তাকে সবসময় অগ্রাধিকার দেয় রাশিয়া। ইউক্রেন থেকে স্পষ্ট হুমকি বিদ্যমান। এ বিষয়ে ক্রেমলিনকে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।’
এবার আইন করে ইন্টারনেটের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে রুশ সরকার। চরমপন্থী হিসেবে বিবেচিত কনটেন্ট অনলাইনে ছড়ালে গুণতে হবে পাঁচ হাজার রুবল পর্যন্ত জরিমানা। বিরোধীদের চরম সমালোচনার মুখে নিম্নকক্ষ ডুমায় ৬৮ শতাংশ ভোটে পাস হয় বিলটি। আগামী ১ সেপ্টেম্বর উচ্চকক্ষ ফেডারেশন কাউন্সিলে পাসের পর বিলটি আইনে পরিণত হবে। ব্যবহারকারীরা চরমপন্থী কনটেন্টগুলো অনুসন্ধান করলেই শাস্তির মুখে পড়বেন বলে জানান, দেশটির ডিজিটাল উন্নয়ন মন্ত্রী মাকসুদ শাদায়েভ।
তিনি বলেন, ‘যদি কোনো ব্যবহারকারী চরমপন্থী বা উগ্রপন্থী কনটেন্ট সম্পর্কে না জানেন তাহলে তাকে সাজার মুখে পড়তে হবে না। এছাড়া ভিপিএন ব্যবহার করে অপরাধ করার কোনো উদ্দেশ্য না থাকলে সেসব ব্যবহারকারীও শাস্তির আওতায় পড়বেন না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে ব্যবস্থা নেয়ার আগে তাদের অবশ্যই প্রমাণ দেখাতে হবে।’
রাশিয়ার বিচার মন্ত্রণালয় ৫০০ পৃষ্ঠারও বেশি উগ্রপন্থী কনটেন্টের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। যেখানে প্রয়াত বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনির দুর্নীতি দমন তহবিলসহ এলজিবিটি আন্দোলন ও মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্ট মেটা প্ল্যাটফর্মের কার্যকলাপ অন্তর্ভুক্ত আছে। এছাড়া, ভিপিএন ও হোয়াটস অ্যাপ ব্যবহারেও জারি করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। পুতিনের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিবিদ বরিস নাদেজদিন বলেন, আইনটি সমস্যায় ফেলবে রাশিয়ার লাখ লাখ মানুষকে।
রাশিয়ার বিরোধী দলীয় নেতা বরিস নাদেজদিন বলেন, ‘নতুন ডিজিটাল আইন রাশিয়ান সমাজে জনপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। শুধু বিরোধী দল নয়, পার্লামেন্টেও অনেকে এই আইনের বিরোধীতা করেছে। সরকারপন্থী কিছু ব্যক্তিও প্রকাশ্যে এই আইনের সমালোচনা করেছেন।’
তবে আইটি বিশেষজ্ঞ জার্মান ক্লিমেনকোর জানান, রুশ সরকারের হাতে ইন্টারনেট অ্যাক্সেস পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের ব্যবস্থা আছে। তিনি ভ্লাদিমির পুতিনের সহকারী ছিলেন। তার দাবি, ইন্টারনেট ব্যবহারে রুশ জনগণকে সতর্ক করতেই এই পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।
আইটি বিশেষজ্ঞ জার্মান ক্লিমেনকোর বলেন, ‘ভিপিএন নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে কারিগরি কোনো জটিলতা বা সীমাবদ্ধতা নেই। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটেছে বিশ্বব্যাপী। বিদ্যমান হুমকি শনাক্তকরণে এখন তেমন একটা কঠিন কাজ নয়। এ বিষয়ে জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে। ইন্টারনেট ব্যবহারে সাধারণ মানুষকে সচেতন থাকতে হবে।’
মস্কো দীর্ঘদিন ধরেই রাষ্ট্র-সমর্থিত একটি নতুন মেসেজিং অ্যাপ ম্যাক্সসহ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে দেশিয় পরিষেবা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। যদিও বেশিরভাগ রুশ জনগণ এখনও বিদেশি প্ল্যাটফর্মের উপর নির্ভরশীল।