জুলাই আন্দোলনে গুলির মুখেও থামেনি সংবাদ সংগ্রহ, প্রাণ হারিয়েছেন ৬ সাংবাদিক

জুলাই আন্দোলনে পুলিশ ও সাংবাদিকের প্রতীকী ছবি
জুলাই আন্দোলনে পুলিশ ও সাংবাদিকের প্রতীকী ছবি | ছবি: এখন টিভি
3

ঢাকা থেকে সিলেট, যাত্রাবাড়ি থেকে সিরাজগঞ্জ! ২০২৪ এর জুলাই আন্দোলনের দিনগুলোতে রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল দেশের রাজপথ। স্বৈরাচার পতনের দাবিতে উত্তাল সেই গণঅভ্যুত্থানে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকেই। আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ছয় সাংবাদিক। ঢাকার রাজপথ থেকে শুরু করে জেলা শহর পর্যন্ত তারা ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী, তথ্যানুসন্ধানী জনতার কণ্ঠস্বর। আন্দোলনে গুলির মুখেও সংবাদ সংগ্রহে পিছপা হননি তারা। দেশের জন্য উৎসর্গ করেছেন নিজেদের জীবন। তাদের পরিবারের কান্না থামেনি এখনও। সহানুভূতি আর বিচার এখন তাদের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু।

মুহুর্মুহু বুলেটের আওয়াজে উত্তপ্ত ছিল ঢাকাসহ সারাদেশের রাজপথ। ছাত্র-জনতার হার না মানা সাহসী অবস্থানের কারণে স্বৈরাচার পালাতে বাধ্য হয় দেশ থেকে। মানুষ পায় নতুন বাংলাদেশ। তবে ৩৬ দিনের এই পথচলা মোটেও সহজ ছিল না। সকল শ্রেণি পেশার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আর শতশত শহিদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ধরা দিয়েছিল বিজয়।

বিদায়বেলা বাবাকে বলা শেষ কথা-ফি আমানিল্লাহ বাবা। তারপর আর ফেরা হয়নি তার। দিন শেষে যিনি নিয়ম করে ফিরতেন ঘরে, সেই বাবার ছবি হাতে বসে থাকে ছোট্ট মেয়ে মাইমুনা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত হন ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক হাসান মেহেদির। তার অনুপস্থিতে যে কীভাবে নাড়া দেয় সন্তানকে তা বোঝানো যায় না কোনো ক্যামেরায়।

শহিদ সাংবাদিক মেহেদির স্ত্রী বলেন, ‘আমার মেয়েটা স্কুলে যায়। মাঝে মাঝে বাসায় এসে আমার বড় ভাইকে বলে তুমি আমারে কালকে একটু স্কুলে নিয়ে যাইয়ো। সবার বাবা না সবাইকে স্কুলে নিয়ে যায়। আমার তো বাবা নেই। বাবা তো দাদির বাসায়।’

আরও পড়ুন:

১৮ জুলাই যাত্রাবাড়িতে সাংবাদিকদের মধ্যে প্রথম শহিদ হন হাসান মেহেদি। একই দিন বিকালে উত্তরা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে দৈনিক ভোরের আওয়াজের প্রতিবেদক শাকিল হোসাইন শহিদ হন।

এছাড়া ১৯ জুলাই সিলেট শহরে দৈনিক নয়াদিগন্তের সিলেট প্রতিনিধি আবু তাহের মুহাম্মদ তুরাব নামে আরেক সাংবাদিক গুলিতে প্রাণ হারান। একই দিনে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় ফ্রিল্যান্সার ফটোসাংবাদিক তাহির জামান প্রিয় গুলিবিদ্ধ হয়ে চলে যান না ফেরার দেশে।

৪ আগস্ট সিরাজগঞ্জে দৈনিক খবরপত্রের প্রতিবেদক সাংবাদিক প্রদীপ কুমার ভৌমিক গুলিতে প্রাণ হারানোর পর সর্বশেষ ৫ আগস্ট সিলেটের হবিগঞ্জে বানিয়াচং থানার সামনে নিহত হন স্থানীয় সাংবাদিক হোসেন আখুঞ্জি।

জুলাই আন্দোলনের এক বছর পর কেমন আছেন জুলাইয়ে প্রাণ হারানো এই সাংবাদিকদের পরিবার?

শহিদ সাংবাদিক হাসান মেহেদির স্ত্রী বলেন, ‘আমি যদি জানতাম ও ওই দিন মারা যাবে তাহলে আমি আমার জীবনের সব শক্তি দিয়ে ওরে আটকায় ফেলতাম। আমি ওরে যাইতে দিতাম না। দরকার ছিল না আমার দেশ স্বাধীন। আমার দরকার ছিল আমার সন্তানের বাবারে।’

শহিদ সাংবাদিক তুরাবের বড় ভাই আবুল আহসাম মো. আজরফ বলেন, ‘এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আমাদের পরিবার যে রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে সেটাই আমাদের সার্থকতা।’

আরও পড়ুন:

শহিদ সাংবাদিক প্রদীপ কুমার ভৌমিকের ছোট ছেলে সুজন কুমার ভৌমিক বলেন, ‘সে কোনো দলের ছিল না। সে তার পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য সবার সাথেই থাকতো।’

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সাংবাদিকদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, আন্দোলনের নেতারা বলছেন সাহসী সাংবাদিকরাই আন্দোলনের চিত্র তুলে ধরে তা ছড়িয়ে দেন মানুষের হৃদয়ে।

জুলাই সংগঠক উমামা ফাতেমা বলেন, ‘সাংবাদিকরা ছিলেন তারা ওই সময়ে নিজেদের দায়িত্ব অনুভব করে তারা নানানভাবে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কানেক্ট হয়ে সাহায্য করেছে। সবার তথ্য সবার কাছে পাঠানো।’

জুলাই সংগঠক সাদিক কায়েম বলেন, ‘কিছু সাহসী সাংবাদিক আমাদের এই মিডিয়া হাউসগুলোতে আমাদের নয় দফার যে প্রেস রিলিজ এবং ১৯ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত প্রতিদিনের যে প্রেস রিলিজ ছিল সেগুলো তারা গ্রহণ করেছে। তারা সেগুলো আবার দেশিয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোতে ছড়িয়ে দিয়েছে। যেই সাংবাদিকরা সেই সময় সাহসের মাধ্যমে এসব কাজ করেছে তাদেরকে আমরা স্যালুট জানাতে চায়।’

আরও পড়ুন:

নিহত সাংবাদিকদের আত্নত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও আলোচনা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলছেন, জুলাই আন্দোলনে প্রাণ হারানো সাংবাদিকদের পরিবার যেন অবহেলার শিকার না হয় সে বিষয়ে সচেতন সরকার।

প্রেস সচিব বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনে ৬ জন সাংবাদিক মারা গেছে তাদেরকে আসলে মার্ডার করা হয়েছে। সাংবাদিকতা ঝুঁকির পেশা। তারা যে ঝুঁকি নিয়েছে সেটা চিন্তা করা যায় না। মন্ত্রণালয় এদের নিয়ে কাজ করছে। তারা সবসময় আমাদের স্মরণে থাকবে।’

জুলাই আন্দোলনের এক বছর পেরিয়ে গেলেও নিহত সাংবাদিকদের পরিবারগুলো এখনো অপেক্ষায় স্বীকৃতির, সহমর্মিতার, বিচার আর মানবিকতার।

সেজু