ইসলাম এ সম্পর্কে কী বলে? ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে, বিজ্ঞানীরা ভূমিকম্পকে প্লেট টেকটোনিক্সের ফল হিসেবে দেখলেও, মুসলমানরা এই আকস্মিক বিপর্যয়কে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে দেখেন না। বরং এটিকে মহান আল্লাহ তাআলার ক্ষমতার একটি নিদর্শন (Sign of God's Power) এবং মানুষের জন্য সতর্কতা ও ভীতি প্রদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা পাপ কাজ থেকে দূরে থাকার এবং আল্লাহর দিকে ফিরে আসার আহ্বান জানায়।
আরও পড়ুন:
মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন:
আরবি আয়াত: وَ لَنَبۡلُوَنَّكُمۡ بِشَیۡءٍ مِّنَ الۡخَوۡفِ وَ الۡجُوۡعِ وَ نَقۡصٍ مِّنَ الۡاَمۡوَالِ وَ الۡاَنۡفُسِ وَ الثَّمَرٰتِ ؕ وَ بَشِّرِ الصّٰبِرِیۡنَ
বাংলা উচ্চারণ: ওয়ালা নাবলু ওয়ান্নাকুম বে শাইয়েম মেনাল খাওফে ওয়াল জুয়েঁ ওয়া নাকছেম মিনাল আমওয়ালে ওয়াল আনফুছে ওয়াচ্ছামারাত, ওয়াবাস্সেরেচ্ছাবিরিন।
অর্থ: “আমি তোমাদেরকে ভয়, ক্ষুধা ও ক্ষতি দিয়ে এবং প্রাণহানি ও সম্পত্তি এবং ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে অবশ্যই পরীক্ষা করব। আর আপনি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫)
আল্লাহর অবাধ্যতার ফল—ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়েছিল যে জাতি
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা এমন বহু জাতির ঘটনা বর্ণনা করেছেন, যারা নিজেদের সীমালঙ্ঘন ও অবাধ্যতার কারণে ধ্বংসের শিকার হয়েছিল। এই ধ্বংসের মাধ্যমগুলোর মধ্যে ভূমিকম্প ছিল অন্যতম। এই ঘটনাগুলো আমাদের জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা যে, আল্লাহ যেকোনো সময় তাঁর বান্দাদেরকে সতর্ক করতে পারেন বা পাকড়াও করতে পারেন।তেমনি এক জাতি হলো সামুদ জাতি (Thamud), যারা নবি সালেহ (আ.)-এর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে অবাধ্যতা করেছিল। তাদের ধ্বংসের ঘটনা পবিত্র কোরআনে এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে:
আরবি আয়াত: فَأَخَذَتْهُمُ الرَّجْفَةُ فَأَصْبَحُوا فِي دَارِهِمْ جَاثِمِينَ
বাংলা উচ্চারণ: ফাআখাজাতহুমুর রাজফাতু ফাআসবাহু ফী দারিহিম জাসিমীন।
অর্থ: “অতঃপর ভূমিকম্প (রাজফাহ) তাদের গ্রাস করল, আর তারা নিজ গৃহে উপুড় হয়ে পড়ে রইল।” (সুরা আল-আরাফ: আয়াত ৭৮)
কোরআনুল কারিমের এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, কিছু জাতিকে তাদের বিদ্রোহ ও সীমালঙ্ঘনের শাস্তি হিসেবে আল্লাহ তাআলা ভূমিকম্প বা প্রকম্পন (Rajfah) দিয়েছিলেন। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে ভূমিকম্প শুধুমাত্র প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, বরং আল্লাহর ইচ্ছা এবং ন্যায়ের বাস্তবায়নও হতে পারে।
আরও পড়ুন:
ভূমিকম্প শুধুই গজব নয়, আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কতা বার্তা
ভূমিকম্পসহ সকল প্রাকৃতিক বিপর্যয় কেবল আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি বা গজব নয়, বরং তা একই সঙ্গে মানুষের জন্য তাওবা (অনুশোচনা), আত্মসমালোচনা ও আল্লাহর দিকে ফিরে আসার জন্য এক গভীর সতর্কবার্তা (Warning)। এসব ঘটনা বান্দাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে তারা সৃষ্টিকর্তার সামনে কতটা অসহায়।এই প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন:
আরবি আয়াত: وَ مَا مَنَعَنَاۤ اَنۡ نُّرۡسِلَ بِالۡاٰیٰتِ اِلَّاۤ اَنۡ كَذَّبَ بِهَا الۡاَوَّلُوۡنَ ؕ وَ اٰتَیۡنَا ثَمُوۡدَ النَّاقَۃَ مُبۡصِرَۃً فَظَلَمُوۡا بِهَا ؕ وَ مَا نُرۡسِلُ بِالۡاٰیٰتِ اِلَّا تَخۡوِیۡفًا
বাংলা উচ্চারণ: ওয়া মা- মানা'আনা আং নুর্সিলা বিল্আ-য়া-তি ইল্লা- আন কাযযাবা বিহাল আওওয়ালূন। ওয়া আ-তাইনা- ছামূদান্ না-ক্বাতা মুবসিরাতান ফাযলামূ বিহা-। ওয়া মা- নুসিলু বিল্আ-য়া-তি ইল্লা- তাখবী-ফা-।
অর্থ: “আর আমাদের নিদর্শনসমূহ (মু'জিযা) প্রেরণ করা থেকে আমাদেরকে কিছুই নিবৃত্ত করেনি, শুধু এ কারণেই যে, পূর্ববর্তী লোকেরা এগুলোকে মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল। আর আমি সামুদ জাতিকে দিয়েছিলাম উটনী—এক সুস্পষ্ট নিদর্শনস্বরূপ; কিন্তু তারা তার প্রতি জুলুম করেছিল। আর আমি তো ভয়-সতর্কতা প্রদর্শনের জন্যই নিদর্শনসমূহ পাঠিয়ে থাকি।” (সুরা আল-ইসরা: আয়াত ৫৯)
এই আয়াতের মাধ্যমে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ভূমিকম্পের মতো 'নিদর্শন'গুলোর উদ্দেশ্য হলো বান্দারা যেন পাপ ও গাফিলতি থেকে বিরত হয় এবং আল্লাহর দিকে মনোযোগী হয়ে নিজেদের জীবনধারায় পরিবর্তন আনে। এটি মুমিনদের জন্য এক সুযোগ, যাতে তারা নিজেদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা (Istighfar) করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে।
পৃথিবীর কম্পন আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন: তিনিই সবকিছুর ওপর সর্বশক্তিমান
যদিও ভূত্বকের অভ্যন্তরে টেকটোনিক প্লেটের (Tectonic Plates) নড়াচড়ার কারণে পৃথিবী কাঁপে, কিন্তু এই কম্পন ও অস্থিরতার চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ মহান আল্লাহ তাআলার হাতেই। তিনিই পৃথিবী এবং এর ভিতরের সব শক্তিকে ধারণ করেন। আল্লাহর ইচ্ছাই এই পৃথিবীকে স্থির রাখে, আর এই ঘটনাই তাঁর অসীম কুদরতের (Divine Power) অন্যতম নিদর্শন। কেননা আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন:
আরবি আয়াত: إِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
বাংলা উচ্চারণ: ইন্নাল্লাহা আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর।
অর্থ: “নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছুর ওপর সর্বশক্তিমান।” (সুরা বাকারা: আয়াত ২০)
এই আয়াতের মাধ্যমে একজন মুমিন এই শিক্ষা লাভ করে যে, জাগতিক বিজ্ঞান যতই শক্তিশালী হোক না কেন, চূড়ান্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কেবল মহান আল্লাহরই।
আরও পড়ুন:
কিয়ামতের সেই প্রলয়ঙ্কর কম্পন: পৃথিবী যখন তার সমস্ত গোপন কথা বলে দেবে
ভূমিকম্পের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও চূড়ান্ত রূপটি সংঘটিত হবে কিয়ামত (Day of Judgment) ঘনিয়ে আসার সময়। কোরআনুল কারিমের একাধিক স্থানে সেই ভয়াবহ মুহূর্তের বর্ণনা এসেছে, যখন আল্লাহর কুদরতে পৃথিবীর কম্পন মানবজাতির কাছে এক চরমতম বাস্তবতা নিয়ে হাজির হবে।
মহাপ্রলয়ের ভূকম্পন: আতঙ্ক ও বিভীষিকা (সুরা হজ)
কিয়ামতের শুরুতে সেই ভূমিকম্পের তীব্রতা কেমন হবে, তা মহান আল্লাহ তাআলা এভাবে বর্ণনা করেছেন:
আরবি আয়াত: یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اتَّقُوۡا رَبَّكُمۡ ۚ اِنَّ زَلۡزَلَۃَ السَّاعَۃِ شَیۡءٌ عَظِیۡمٌ یَوۡمَ تَرَوۡنَهَا تَذۡهَلُ كُلُّ مُرۡضِعَۃٍ عَمَّاۤ اَرۡضَعَتۡ وَ تَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمۡلٍ حَمۡلَهَا وَ تَرَی النَّاسَ سُكٰرٰی وَ مَا هُمۡ بِسُكٰرٰی وَ لٰكِنَّ عَذَابَ اللّٰهِ شَدِیۡدٌ
বাংলা উচ্চারণ: ইয়া আইয়্যুহান্নাসুত্তাকু রব্বাকুম, ইন্না যালযালাতাস সাআতি শাইয়ুন আযীম। ইয়াওমা তারাওনাহা তাযহালু কুল্লু মুরদি'আতিন আম্মা আরদ'আত ওয়া তাদা'উ কুল্লু যা-তি হামলিন হামলাহা ওয়া তারান্নাসা সুকারা ওয়ামা হুম বিসুকারা ওয়ালাকিন্না আযাবাল্লা-হি শাদীদ।
অর্থ: “নিশ্চয় কিয়ামতের ভূকম্পন একটি ভয়াবহ ব্যাপার। সেদিন তোমরা দেখবে প্রত্যেক স্তন্য দানকারিনী আপন দুগ্ধপোষ্য শিশুকে ভুলে যাবে এবং প্রত্যেক গর্ভধারিণী তার গর্ভপাত করে ফেলবে, আপনি দেখবেন মানুষকে মাতালের মতো, অথচ তারা মাতাল নয়। তবে আল্লাহর আজাবই কঠিন।” (সুরা হজ: আয়াত ১-২)
সুরা যিলযালের আশ্চর্য ফজিলত: এই সুরাকে কোরআনের অর্ধেক বলা হয় কেন?
পবিত্র কোরআনের কিছু ছোট সুরার এমন অসাধারণ ফজিলত রয়েছে, যা আমলের দিক থেকে অনেক দীর্ঘ সুরার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের একটি বরকতময় সুরা হলো সুরা যিলযাল। এর আধ্যাত্মিক গুরুত্ব এত বেশি যে, একে কোরআনুল কারিমের অর্ধেক বলা হয়েছে।
সাহাবি হজরত আনাস (রা.) এবং ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) এই তিনটি ছোট সুরার ফজিলত সম্পর্কে বিশেষ উপমা ব্যবহার করেছিলেন:
সুরা যিলযালের মহিমা
কিয়ামতের ভয়াবহতা ও চূড়ান্ত জবাবদিহিতা নিয়ে নাযিল হওয়া সুরা যিলযাল-কে রাসুলুল্লাহ (সা.) ‘কোরআনের অর্ধেক’ বলে উপমা দিয়েছিলেন। এই উপমা এই সুরা পাঠের আধ্যাত্মিক প্রতিদান এবং এর বিষয়বস্তুর গভীর গুরুত্বকে তুলে ধরে। এর মাধ্যমে বান্দা কোরআনের একটি বৃহৎ অংশের সওয়াব লাভ করতে পারে।
অন্যান্য সুরার বিশেষ মর্যাদা
কেবল সুরা যিলযাল নয়, আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ সুরা সম্পর্কেও মহানবী (সা.) বিশেষ মর্যাদা ঘোষণা করেছিলেন:
সুরা ইখলাস: এই সুরাকে তিনি ‘কোরআনের এক তৃতীয়াংশ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এর কারণ হলো—সুরা ইখলাস সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর একত্ববাদ (তাওহীদ) ও আল্লাহর পরিচয়কে তুলে ধরে, যা ইসলামের মূল ভিত্তি।
সুরা কাফিরূন: অন্যদিকে, সুরা কাফিরূন-কে বলা হয়েছে ‘কোরআনের এক চতুর্থাংশ’। এই সুরাটি পাঠের মাধ্যমে বান্দা শিরক বা অংশীদারিত্বের মতো ঘোরতর পাপ থেকে মুক্ত থাকার বার্তা দেয়।
জমিনের সাক্ষ্যদান ও কৃতকর্মের হিসাব (সুরা যিলযাল)
কিয়ামতের কম্পনের উদ্দেশ্য কেবল ধ্বংস নয়, বরং মানুষের কৃতকর্মের হিসাবের জন্য জমিনকে প্রস্তুত করা। সেই সময়ের ঘটনা ও মানুষের চূড়ান্ত পরিণতির চিত্র তুলে ধরে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:
আরবি আয়াত: إِذَا زُلْزِلَتِ الْأَرْضُ زِلْزَالَهَا وَأَخْرَجَتِ الْأَرْضُ أَثْقَالَهَا وَقَالَ الْإِنسَانُ مَا لَهَا یَوۡمَئِذٍ تُحَدِّثُ اَخۡبَارَهَا بِاَنَّ رَبَّكَ اَوۡحٰی لَهَا یَوۡمَئِذٍ یَّصۡدُرُ النَّاسُ اَشۡتَاتًا ۬ۙ لِّیُرَوۡا اَعۡمَالَهُمۡ ؕ
বাংলা উচ্চারণ: ইযা যুলযিলাতিল আরদু যিলযালাহা। ওয়া আখরাজাতিল আরদু আছক্বালাহা। ওয়া ক্বলাল ইনসানু মা-লাহা। ইয়াওমাইযিন তুহাদ্দিছু আখবারাহা। বিআন্না রব্বাকা আওহা লাহা। ইয়াওমাইযিঁই ইয়াসদুরুন্নাসু আশতাতাল লিয়ুরাও আ’মালাহুম।
অর্থ: “যখন জমিন প্রবল কম্পনে প্রকম্পিত হবে। আর জমিন তার বোঝা বের করে দেবে। আর মানুষ বলবে, এর কী হলো? সেদিন জমিন তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে। কারণ আপনার রব তাকে নির্দেশ দিয়েছেন। সেদিন মানুষ বিক্ষিপ্তভাবে বের হয়ে আসবে যাতে দেখানো যায় তাদেরকে তাদের নিজদের কৃতকর্ম।” (সুরা আজ-জিলজাল: আয়াত ১-৬)
এই বর্ণনাগুলি মুমিনদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী ভূমিকম্পের চেয়ে কিয়ামতের ভূকম্পন হবে অত্যন্ত ভয়াবহ এবং অনিবার্য। এটি বান্দাকে সর্বদা তাকওয়া (আল্লাহভীতি) অবলম্বন করার এবং পরকালের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানায়।
পাপকর্ম বাড়লে ভূমিকম্প: নবীজি (সা.)-এর ভাষায় কিয়ামতের বিশেষ আলামত
রাসুলুল্লাহ (সা.) কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার বিভিন্ন আলামত (Sign of Qiyamah) বর্ণনা করতে গিয়ে ভূমিকম্প বৃদ্ধির বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। এটি স্পষ্ট করে যে, ঘন ঘন ভূমিকম্প হওয়া বিশ্বজুড়ে সামগ্রিক নৈতিক অবনতির ফল।
কিয়ামতের প্রধান আলামতসমূহ নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
আরবি আয়াত: لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يُقْبَضَ الْعِلْمُ وَتَكْثُرَ الزَّلَازِلُ وَيَتَقَارَبَ الزَّمَانُ وَتَظْهَرَ الْفِتَنُ وَيَكْثُرَ الْهَرْجُ وَهُوَ الْقَتْلُ الْقَتْلُ حَتَّى يَكْثُرَ فِيكُمْ الْمَالُ فَيَفِيضَ
বাংলা উচ্চারণ: লা তা’কুমুস সাআতু হাত্তা ইউকব্দাল ইলমু ওয়া তাকছুরায যালা-যিলু ওয়া ইয়াতাক্বারাবায যামানু ওয়া তাযহারুল ফিতানু ওয়া ইয়াকছুরাল হারজু, ওয়াহুওয়াল ক্বাতলু, ক্বাতলু হাত্তা ইয়াকছুরা ফীকুমুল মা-লু ফায়াফীদ্বা।
অর্থ: “ক্বিয়ামাত (কিয়ামত) কায়েম হবে না, যে পর্যন্ত না ইল্ম (জ্ঞান) উঠিয়ে নেওয়া হবে, অধিক পরিমাণে ভূমিকম্প হবে, সময় সংকুচিত হয়ে আসবে, ফিতনা প্রকাশ পাবে এবং হারজ বৃদ্ধি পাবে। হারজ হলো খুন-খারাবী। (এমনকি) তোমাদের ধন-সম্পদ এত বৃদ্ধি পাবে যে, উপচে পড়বে।” (সহীহ বুখারী: ১০৩৬)
এই হাদিসটি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, যখন সমাজে জ্ঞান উঠে যাবে, ফিতনা (বিশৃঙ্খলা) বাড়বে এবং খুন-খারাবি বৃদ্ধি পাবে, তখন ভূমিকম্পের আধিক্য ঘটবে। তাই এই ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলো আল্লাহর দিকে ফিরে আসার এবং নিজেদের জীবনযাত্রা সংশোধন করার জন্য মুমিনদের প্রতি এক চরম আহ্বান।
আরও পড়ুন:
ভূমিকম্প হলে কী করবেন?
ভূমিকম্পের মুখোমুখি হলে একজন মুমিনের প্রধান কাজ হলো আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা। এ বিষয়ে হাদিসে সুস্পষ্ট নির্দেশ এসেছে:
আরবি হাদিস (অংশ): فَافْزَعُوا إِلَى ذِكْرِهِ وََدُعَائِهِ وَاسْتِغْفَارِهِ
বাংলা উচ্চারণ: ফাফযাউ ইলা যিকরিহি ওয়া দুআ-ইহি ওয়াসতিগফা-রিহি।
অর্থ: “এ ধরনের কিছু ঘটলে আল্লাহর স্মরণে, দোয়ায় ও ইস্তিগফারে ঝুঁকে পড়ো।” (তাবারানি)
অর্থাৎ, কম্পন শুরু হলে দেরি না করে আল্লাহর জিকির, বেশি বেশি দোয়া পাঠ এবং আন্তরিকভাবে ইস্তিগফার (ক্ষমাপ্রার্থনা) করতে হবে।
আরও পড়ুন:
হযরত আলি বিন আবি তালিব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যখন কোনো সমাজে পনেরটি বিষয়ে লিপ্ত হবে, তখন তাদের ওপর বিপদ-আপদ নেমে আসবে। এই নৈতিক অবক্ষয়ের ফলেই ভূমিধ্বস বা চেহারা বিকৃতির মতো আজাব আসতে পারে।
আরবি হাদিস (অংশ): إِذَا كَانَ الْمَغْنَمُ دُوَلاً وَالْأَمَانَةُ مَغْنَمًا ... فَلْيَرْتَقِبُوا عِنْدَ ذَلِكَ رِيحًا حَمْرَاءَ أَوْ خَسْفًا وَمَسْخًا
বাংলা উচ্চারণ: ইযা কা-নাল মাগনামু দুওয়ালান, ওয়াল আমা-নাতু মাগনামান... ফালইয়ারতাক্বিবূ ইনদা যা-লিকা রীহান হামরা-আ আও খাসফান ওয়া মাসখান।
অর্থ (সম্পূর্ণ অংশের সারাংশ): “যখন গনিমতের সম্পদ (ব্যক্তিগত) সম্পদে পরিণত হবে, আর আমানাত (বিশ্বাস) লুটের সম্পদে পরিণত হবে, (তখন তোমরা)... সেই সময় একটি অগ্নিবায়ু অথবা ভূমিধ্বস (খাসফ) অথবা চেহারা বিকৃতির (মাসখ) আজাবের অপেক্ষা করবে।”
গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় (পনেরটির মধ্যে):
- গনিমতের সম্পদ ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হওয়া।
- আমানাত (বিশ্বাস) লুটের সম্পদে পরিণত হওয়া।
- যাকাতকে জরিমানা হিসেবে গণ্য করা।
- পুরুষ তার স্ত্রীর আনুগত্য করা এবং মায়ের অবাধ্য হওয়া।
- বন্ধুর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা কিন্তু পিতার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা।
- মসজিদে শোরগোল করা।
- সবচেয়ে খারাপ চরিত্রের লোক তার সম্প্রদায়ের নেতা হওয়া।
- ব্যক্তিকে তার অনিষ্টতার ভয়ে সম্মান করা।
- মদ পান ও রেশমি বস্ত্র পরিধান করা।
- নর্তকী গায়িকাদের প্রতিষ্ঠিত করা এবং বাদ্যযন্ত্রের বৃদ্ধি হওয়া।(তিরমিজি, হাদিস: ২২১০)
এই হাদিসটি স্পষ্ট করে, ভূমিকম্প বা ভূমিধ্বস (খাসফ) হলো মানব সমাজের নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের একটি চূড়ান্ত ফল, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে চূড়ান্ত আজাব বা কিয়ামতের আলামত হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।
প্রতিটি কম্পনই আল্লাহর সতর্কবার্তা: ফিরে আসুন মহান রবের দিকে
ভূমিকম্পের প্রতিটি ঝাঁকুনি আমাদের জীবনের জন্য এক গভীর শিক্ষা—যা মনে করিয়ে দেয় যে আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া এই পৃথিবীতে কোনো কিছুই স্থির নয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমস্ত অহংকার ভেঙে চুরমার করে দেওয়া এই মুহূর্তগুলো আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান রবের দিকে ফিরে আসার এবং নিজেদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানায়।
এই বিষয়ে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা মানুষকে এক কঠিন প্রশ্ন করেছেন:
আরবি আয়াত: ءَاَمِنۡتُمۡ مَّنۡ فِی السَّمَآءِ اَنۡ یَّخۡسِفَ بِكُمُ الۡاَرۡضَ فَاِذَا هِیَ تَمُوۡرُ
বাংলা উচ্চারণ: আ-আমিন্তুম মান ফিস্সামা-য়ি আইঁ ইয়াখ্সিফা বিকুমুল আরদ’আ ফা-ইযা- হিয়া তামূর।
অর্থ: “তোমরা কি নিশ্চিত হয়ে গেছো যে, যিনি আসমানে রয়েছেন তিনি তোমাদেরকেসহ এ জমিনকে ধ্বসিয়ে দেবেন না, অতঃপর আকস্মিকভাবে তা থর থর করে কাঁপতে থাকবে?” (সুরা মুলক: আয়াত ১৬)
এই আয়াতটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, পৃথিবীর সমস্ত স্থিরতা কেবল আল্লাহর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। তাই প্রতিটি কম্পনই আমাদের পাপ থেকে বিরত থাকার এবং আল্লাহর বিধানের দিকে ফিরে আসার এক চূড়ান্ত সতর্কবার্তা।
আরও পড়ুন:





