পঞ্চগড়ে ড্রেজারের মাধ্যমে পাথর উত্তোলন, বাড়ছে ভূমিধ্বসের ঝুঁকি

পঞ্চগড়ে ড্রেজার ব্যবহার করে পাথর উত্তোলন
পঞ্চগড়ে ড্রেজার ব্যবহার করে পাথর উত্তোলন | ছবি: এখন টিভি
0

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় আবারো ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনের মহোৎসব শুরু হয়েছে। নদী ও সমতলের ফসলি জমিতে রাত-দিন চলছে কয়েকশ’ ড্রেজার মেশিন। প্রশাসন নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করলেও থামানো যাচ্ছে না প্রভাবশালী ড্রেজার চক্রকে। ইজারার কার্যাদেশ পাওয়ার আগেই বেপরোয়া পাথর উত্তোলন ভূমিধ্বস ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বলছেন পরিবেশবিদরা।

দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড় পাথরের রাজ্য হিসেবে পরিচিত। জেলার সদর তেঁতুলিয়া উপজেলার সমতল ভূমি ও নদীতে প্রচুর পরিমাণে পাথর পাওয়া যায়। এখানকার বেশিরভাগ মানুষের প্রধান পেশা পাথর উত্তোলন। কিন্তু ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করায় পাথর উত্তোলনে নিষেধাজ্ঞা দেয় প্রশাসন।

দীর্ঘ ৫ বছর বন্ধ থাকার পর ফের শুরু হয়েছে নিষিদ্ধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর তোলার মহোৎসব। পাথর মহালের ইজারা দেয়ার প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও কার্যাদেশ পাওয়ার আগেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে প্রভাবশালী মহল। পতিত ও ফসলি জমি এবং নদীর বুক চিরে দৈনিক কয়েকশ ড্রেজার মেশিন দিয়ে তোলা হচ্ছে পাথর। দিনের পাশাপাশি রাতেও বিকট শব্দে চলে এসব মেশিন । সদর ও তেঁতুলিয়া উপজেলায় বেশিরভাগ স্থানে পানি ও বালু উত্তোলনের নাম করে অবৈধভাবে তোলা হচ্ছে এসব পাথর।

স্থানীয় সচেতন বাসিন্দাদের মধ্যে একজন বলেন, ‘ড্রেজার পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। এটা আসলে পরিবেশের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসতে পারে। কারণ আমাদের জেলাটি হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত।’

আরেকজন বলেন, ‘আমরা চাই এই ধরনের ড্রেজারের ব্যবহার বন্ধ হোক এবং পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক থাকুক।’

গত ১৫ জানুয়ারি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে পাথর কোয়ারিগুলোর ইজারার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার নোটিশ প্রকাশিত হলে এর অপব্যাখ্যা দিয়ে শুরু হয় পাথর উত্তোলন।

পাথর উত্তোলনের জন্য বেছে নেয়া হয় বেশিরভাগ নদীর দুর্গম এলাকাকে। করতোয়া, সাঁও, ডাহুক, তালমা, চাওয়াইসহ নদীর বুকে এখন ড্রেজারের ক্ষত।

এছাড়া সমতলের কিছু পতিত জমি ও ফসলি জমি থেকেও একই কায়দায় তোলা হচ্ছে পাথর। এতে ভূমিধ্বস মারাত্মক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা।

পঞ্চগড় বাপার সভাপতি একেএম আনোয়ারুল খায়ের বলেন, ‘গোটা তেঁতুলিয়া উপজেলাটা একটা কঙ্কালের মতো হয়ে গেছে, এমন একটা অবস্থা, যেখানে সেখানে গর্ত। দিনের পর দিন চলছে ভূগর্ভ থেকে পাথর উত্তোলন, এতে তো ভূগর্ভটা শূন্য হয়ে যাচ্ছে।’

জেলার ১৯টি পাথর মহালের মধ্যে ১৬টির ইজারা দেয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে জেলা প্রশাসন। এর মধ্যে একটির কার্যাদেশ মিলেছে। অভিযোগ আছে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে এসব মহাল থেকে পাথর উত্তোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে পাথর-বালি যৌথ ফেডারেশন।

দৈনিক এসব সাইট প্রতি ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হচ্ছে বলে দাবি করেন মেশিন মালিকরা। দেড়শ’ থেকে ২০০ সাইট থেকে পাওয়া বিরাট অঙ্কের টাকার ভাগ বাটোয়ারা রোজ পৌঁছে যায় প্রভাবশালী সব মহলে।

পঞ্চগড় বাপার সাধারণ সম্পাদক আজহারুল ইসলাম জুয়েল বলেন, ‘পঞ্চগড়ের পরিবেশ রক্ষা করতে হলে এসব ড্রেজার মেশিন বন্ধ করতে হবে। তবে সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে সনাতন পদ্ধতিতে তোলা যেতে পারে।’

পঞ্চগড় জেলা পরিবেশ পরিষদের সভাপতি তৌহিদুল বারী বাবু বলেন, ‘বাংলাদেশের এই অঞ্চলটা হলো দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। এখানে একবার যদি ভূমিকম্প হয়, পুরো তেঁতুলিয়া উপজেলাটা তলিয়ে যাবে। উপজেলা এবং জেলা প্রশাসন আছে, আমি তাদেরকে অনুরোধ করবো যেন তারা এই বিষয়টি আমলে নেয়।’

তবে স্থানীয় শ্রমিক ও পাথর ব্যবসায়ীদের দাবি তারা সনাতন পদ্ধতিতেই পাথর উত্তোলন করছেন। এটিই তাদের জীবিকার মাধ্যম। অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পাথরবালি যৌথ ফেডারেশনের নেতাও।

পঞ্চগড় পাথর বালি যৌথ ফেডারেশনের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এখানে পাথর তুলতে কোনো ড্রেজার মেশিন ব্যবহার হয় না আমার জানামতে। আমাদের লোকবল আছে বিভিন্ন জায়গায়। তাদের মাধ্যমে আমরা অভিযান চালাই। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের সহযোগিতা করে।’

তবে পথের মোড়ে মোড়ে থাকা সোর্সের মাধ্যমে প্রশাসনের অভিযানে বের হওয়া মাত্রই খবর পৌঁছে যায় পাথর কোয়ারিতে। মামলা আর ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাদণ্ড দেয়া হলেও থামানো যাচ্ছে না অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন।

পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক সাবেত আলী বলেন, ‘খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে এই কোয়ারিগুলো ইজারা দেয়ার আগে এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এরপরে আমরা ইজারায় যাবো। ইজারা দেয়ার আগ পর্যন্ত এই কোয়ারিগুলো থেকে কোনো পাথর উত্তোলন করা সম্পূর্ণ অবৈধ।’

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার চা বাগান আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সবার নজর কাড়লেও এখন প্রান্তিক জনপদটির সবুজের বুকে শত শত ড্রেজারের ক্ষত। প্রকৃতি ও পরিবেশের তোয়াক্কা না করে পাথর উত্তোলন করে ফুলে ফেঁপে উঠছেন এক শ্রেণির মানুষ, তেমনি বাড়ছে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকি। ড্রেজার মেশিন নয়, পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন হোক— এমনটাই চাওয়া এ জনপদের মানুষের।

এসএইচ