প্রমত্যা বিষখালী ও বলেশ্বরী নদী। বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার পূর্ব ও পশ্চিম দিক দিয়ে বয়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে এই নদী। এতো পানি থাকতেও সুপেও পানির তীব্র সংকটে রয়েছেন পাথরঘাটার বাসিন্দারা। একই অবস্থা পটুয়াখালীর কলাপাড়া, রাঙ্গাবালি ও গলাচিপা উপজেলায়। এখানকার পানি এবং মাটিতেও লবণাক্তটা রয়েছে।
পাথরঘাটা উপজেলায় পুকুরে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা হয় সারা বছর। পরে ফিল্টারিং করে স্থানীয় বাসিন্দারা পান করেন। উপজেলার প্রায় ১ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ৫০ ভাগ ও পৌর এলাকায় ২৭ হাজার বাসিন্দাদের মধ্যে ২০ ভাগ মানুষ এখনো সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত বলে জানা গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ‘পাথরঘাটায় টিউবওয়েলের পানি এত লবণাক্ত যে খাওয়ার উপযুক্ত না। এখানকার পানিতে অনেক লবণ। উপরমহল থেকে যদি নজরদারি করা হয় তাহলে অন্তত গরীব, দিনমজুরদের জন্য উপকার হবে।’
বরগুনার তালতলি উপজেলার সোনাকাটা ইউনিয়নের পশ্চিম লালুয়া গ্রামের বাসিন্দারা বছরে মাত্র এক বার ফসল ফলাতে পারেন। বর্ষার সময় শুধু ধান চাষ হয় এই এলাকায়। স্থানীয় কৃষকরা জানান, সিডরের সময় এই এলাকায় লবণাক্ত পানি ঢুকে পরে। তারপর থেকে এখানে ফসলের স্বাভাবিক উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। এ অবস্থার পরিবর্তন চান তারা।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, লবণাক্ত পানির কারণে এখানে শুধু একটি খন্দ হয়। লবণের কারণে ফসল মারা যায়। কৃষকদের দাবি সরকার যেন মিঠা পানির ব্যবস্থা করে।
মানব শরীরে লবণের প্রয়োজন রয়েছে। তবে মাত্রাতিরিক্ত লবণ শরীরের জন্য ক্ষতি কারক। অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি পান করলে ডায়রিয়া, চর্মরোগ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি পান করা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানান এই গবেষক।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিটি হেলথ অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক লিটন চন্দ্র সেন বলেন, ‘কলাপাড়া-কুয়াকাটা থেকে শুরু করে পায়রা নদী পর্যন্ত দ্বিগুনেরও বেশি স্যালাইনিটি পেয়েছিলাম। ইউরিনের সোডিয়াম কনসানট্রেশন স্বাভাবিকের মাত্রার চেয়ে একটু বেশি। ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে আমরা ২২ শতাংশ নারীদের মাঝে হাইপারটেনশন পেয়েছি। যেটি নিঃসন্দেহে সতর্কতামূলক।’
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তথ্য মতে, দেশে নদ নদীর সংখ্যা ৯০৭ টি। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগে রয়েছে ৯৯ টি নদী। এর মধ্যে বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন এলাকার বেশ কিছু নদীর পানিও বেশ লবণাক্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে, দুই ভাবে মাটি লবণাক্ত হচ্ছে । বিপর্যয় এড়াতে লবণাক্তটা আর বাড়তে দেয়া উচিত না বলে মনে করেন তারা।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার রেজিলিয়েন্স এন্ড ইঞ্জিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. ফয়সাল বলেন, ‘স্যালাইন ওয়াটার মূলত আমাদের এখানে দুইভাবে প্রবেশ করে। একটা হলো সারপেস ওয়াটার যেটা ল্যান্ডের ওপর দিয়ে আসে। আরেকটা হলো মাটির নিচ আমাদের যে অ্যাকুইফার আছে সেখানে স্যালাইন ওয়াটার প্রবেশ করে।’
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোস্টাল স্টাডিজ এন্ড ডিজেস্টার ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান ড. হাফিজ আশরাফুল হক বলেন, ‘এই যে লবণাক্ততা এটা পানিতে আর মাটিতে আর বাড়তে দেয়া যাবে না। এবং এটার জন্য একটা সমন্বিত ওয়াটার ইন্টিগ্রেটেড, ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ডেভেলপ করতে হবে।’
লবণাক্ত মাটি পানি শোষণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। মাটিতে অতিরিক্ত লবণ জমে যাওয়ার কারণে পানি মাটির মধ্য দিয়ে সহজে প্রবাহিত হতে পারে না, যার ফলে গাছের শিকড় পানির উৎস থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করতে সক্ষম হয় না। লবণাক্ততার কারণে মাটির গঠনও পরিবর্তিত হয়, যার ফলে মাটি শক্ত হয়ে যায় । এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসকরা। তারা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছেন যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য।
পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন বলেন, ‘যেভাবে দিন দিন লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে জনস্বাস্থ্যের জন্য এবং অদূর ভবিষ্যতে সুপেয় পানির জন্য একটি বিশাল সমস্যা হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গবেষণা করছে। আশা করছি আমরা দ্রুতই ভালো ফলাফল পাব।’
বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নজরে আসার পর আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। যদি বরগুনা জেলার জন্য আলাদা সেচ প্রকল্প নেয়া যায় তাহলে যে সংকট তা দূরীভূত হবে।’
বাংলাদেশে ৩০ শতাংশ কৃষিজমি উপকূলীয় এলাকায় অবস্থিত। প্রায় ২৮ দশমিক ৫ লাখ হেক্টর জমি লবণাক্ততার দ্বারা প্রভাবিত। এর মধ্যে ১০ দশমিক ৫৬ লাখ হেক্টর জমি তীব্র লবণাক্ততায় আক্রান্ত। লবণাক্ততার প্রভাব দিন দিন বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই সমস্যা আরও তীব্র হচ্ছে।