গণভবন। হত্যা, নির্যাতন, গুমসহ নানা ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল গেল দেড় দশকে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ দেশি বিদেশি সংস্থার তদন্তে উঠে এসেছে এ গণভবনকে কেন্দ্র করে অনেক ঘটনার বর্ণনা।
১৩ জুলাই ২০২৪। গণভবনের সংবাদ সম্মেলন থেকেই কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের কটাক্ষ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী।
যার প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অভূতপূর্ব প্রতিবাদ। যদিও শিক্ষার্থীদের এ ফুসে ওঠাকে ভালোমতো নেয় নি তৎকালীন আওয়ামী নেতৃত্ব।
সে সময় আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলীয় এক সম্মেলনে বলেন, যেসব কতিপয় নেতা বক্তব্য রেখেছে তার জবার দেয়ার জন্য ছাত্রলীগসহ....এ বক্তব্যের জের যেমন হবার কথা ছিল, তাই হলো। বহিরাগত সন্ত্রাসীদের নিয়ে একযোগে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে গণভবনের এ বক্তব্যটিকে হত্যা ও নিপীড়নের উস্কানি হিসেবে দেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে, রুয়ান্ডা গণহত্যায় যেভাবে আফ্রিকার জাতিগোষ্ঠী তুতসিদের ‘তেলাপোকা’, জার্মানিতে ইহুদিদের ‘ইদুর’, বসনিয়ায় মুসলিমদের ‘ক্যান্সার’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, সেভাবে হাসিনার দেয়া এ বক্তব্য, তৎকালীন সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, আইনশৃঙ্খলারক্ষাবাহিনী ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ ছাত্র-জনতাকে হত্যা, নির্যাতনের মত মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠনের জন্য উস্কে দিয়েছিলো। যার প্রথম দৃশ্যপট রচিত হয় রংপুরে।
১৭ জুলাই গণভবন থেকে শোকের আবহে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বলা হলেও, কার্যত তারপর থেকে আরও নির্মম নিপীড়ন চালানো হয় ছাত্র-জনতার ওপর। ঢাকার যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, উত্তরা, সায়েন্সল্যাবের মতই ক্ষোভে অগ্নি উত্তাল হয় গোটা দেশ। শহীদী মিছিলে নাম লেখায় দুইশোর বেশি ছাত্রজনতা।
একদিকে কারফিউ অন্যদিকে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে এমন হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর আওয়ামী লীগের সহযোগী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে বৈঠক শেষ করে, দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, এখন থেকে দেখামাত্রই গুলি করা হবে। ছাত্রজনতাকে হত্যার নির্দেশনা দেয়া ১৪ দলের ঐ বৈঠকটিও অনুষ্ঠিত হয় গণভবনে। তারিখ: ২৩ জুলাই ২০২৪।
এরপরের দিনগুলোকে শহীদ আবু সাঈদের পরিবারসহ শহীদ পরিবারকে এনে শান্তনা দেয়াসহ নানা নাটক মঞ্চস্থ হয় এই ঐতিহাসিক গণভবনকে কেন্দ্র করে।
এত কিছু হয়ে যাবার পর ৩ আগস্টে এ গণভবন থেকেই শেখ হাসিনা সেটাই বললেন, যার ন্যূনতম সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিয়েছিলেন মাত্র ২০ দিন আগে। ১৪ জুলাই তিনি বলেছিলেন, আন্দোলনকে ঘিরে আমার কিছু করার নেই। রাজপথে আন্দোলন করছে করতেই থাকবে।
যেখানে ৩ আগস্ট তিনি বলেন, ‘গণভবনের দরজা খোলা। যখনই এ আন্দোলনকারীরা কথা বলতে চায়, আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করতে চায় আমি নিজেই তাদের সঙ্গে বসতে রাজি।’
যদিও পর্দার অন্তরালে ছিল ভিন্ন কিছু! শেষ মুহূর্তেও সীমাহীন বলপ্রয়োগ করে ক্ষমতা আকড়ে ধরে রাখতে গণভবনে কী কী ঘটেছিলো তার এ বর্ণনা উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অভিযোগপত্রে।
এখানে বলা হয়, ৪ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন সাবেক স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করার পরামর্শ দেন। কিন্তু ঐ সময় গণভবনে উপস্থিত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাতসহ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বস্থানীয় কয়েকজন তীব্র বিরোধিতা করলে শেখ হাসিনা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।
প্রসিকিউশনের অভিযোগপত্রে উঠে এসেছে, ৪ আগস্ট রাতে গণভবনে শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তিন বাহিনীর প্রধান, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন, র্যাবের সাবেক ডিজি হারুন অর রশিদ এবং সেনাবাহিনীর কিউএমজি লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুজিবকে নিয়ে বৈঠক করেন।
বৈঠকে তার পরের দিন ঢাকা ‘মার্চ ফর ঢাকা’ কর্মসূচি দমনের বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়। এখানে শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়টি উঠানো হলে বৈঠকে উপস্থিত নিরাপত্তা উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিকী ক্ষুদ্ধ হয়ে বলেন, যা হবার হবে, তিনি ক্ষমতা ছাড়বেন না।
শেখ হাসিনা সেনা প্রধানকে শক্ত হয়, মেরুদন্ড শক্ত করে কঠোর হয়ে বিক্ষোভ দমনের নির্দেশ দেন। অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিকী শেখ হাসিনাকে সমর্থন জানিয়ে বলতে থাকেন, সেনাবাহিনী গুলি চালিয়ে কিছু লোক মেরে ফেললেই বিক্ষোভ এমনিতেই দমন হয়ে যাবে।
ট্রাইব্যুনালে আরও উপস্থাপন করা হয়েছে, ৫ আগস্ট সকালে শেষবারের মত শেখ হাসিনা ৩ বাহিনীর প্রধানদের গণভবনে ডেকে আন্দোলন দমনের নির্দেশনা প্রদান করেন এবং তিনি পুলিশের কাজের প্রশংসা করেন বিপরীতে সেনাবাহিনীর প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এদিকে কারফিউ ভেঙে লক্ষ লক্ষ জনতা রাজপথে নেমে যাবার পর সামরিক কর্মকর্তারা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছেড়ে দেবার পরামর্শ দেন। কিন্তু হাসিনা রেগে গিয়ে বলেন, তাহলে তোমরা আমাকে গুলি করে মেরে ফেলো এবং গণভবনেই কবর দিয়ে দাও।
ঢাকার চারপাশ থেকে যখন গণভবনের খুব কাছাকাছি মিছিলগুলো, তখন এক পর্যায়ে শেখ হাসিনার পা জড়িয়ে ধরে বুঝানোর চেষ্টা করে শেখ রেহানা। পরে সামরিক কর্মকর্তারা সজিব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে কথা বললে, জয়ের কথায় গুম, খুন, বিচার বহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ মাথায় নিয়ে দেড় দশক পরে গণভবন ছেড়ে যান শেখ হাসিনা।