চলুন জেনে নেই, পানিতে প্রাণহানির তিনটি প্রধান কারণ ও তা থেকে বাঁচার উপায়।
পানি মৃত্যুর মূল কারণ মূলত তিনটি।
১. সাঁতার না জানা
অনেকেই সাঁতার না জেনেই পানিতে নেমে পড়েন। এটা একদমই সুইসাইডাল। নদ-নদী, সাগর, হাওর বাওড় কোনো সাধারণ বিষয় নয়। দূর থেকে স্বাভাবিক মনে হলেও সাঁতার না জানলে সামান্য অসতর্কতায় মৃত্যু হতে পরে কয়েক মিনিটেই।
২. পানির গতি-প্রকৃতি না বোঝা
অনেক সময় সাঁতার জানা থাকলেও মানুষ স্রোতের ফাঁদ, নিচের টান (সাকশন), বা ফ্ল্যাশ ফ্লাডের ঝুঁকি সম্পর্কে অবগত থাকে না। সাঁতার জানলেও কোথায় নামা উচিত আর কোথায় থামা উচিত তাও অজানা। হয়তো আমাদের চোখের সামনে আমরা একটি ঝিরি, বহমান নদী বা শান্ত দেখতে সাগর দেখে সেইফ মনে করে নেমে যাই। অনেক সময় বুঝতেই পারি না এর মধ্যে লুকিয়ে আছে মৃত্যু ফাঁদ। পানির গতি প্রকৃতি না বুঝে পানিতে নামার কারণে মৃত্যু হার সবচেয়ে বেশি।
আবার একটিভ সাঁতারের সময় আমাদের শরীর প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি করে। এই কার্বন ডাই-অক্সাইড রিলিজ করে অক্সিজেন নেয়াটা খুবই জরুরি। অনেকেই আমরা জানি না সাঁতারের সময় কীভাবে অক্সিজেন নিতে হয় এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড ছাড়তে হয়। পানিতে মৃত্যুর এটাও অন্যতম কারণ।
৩. অসতর্কতা ও নিয়ম না মানা
পানিতে মৃত্যুর অন্যতম আরেকটি বড় কারণ হলো নিয়ম না মানা। অনেক সময় আমরা সাঁতার না জেনেও লাইফ জ্যাকেট ছাড়া পানিতে নেমে যাই। আবার অচেনা জায়গায় লাফ দিয়ে বসি যা সম্পূর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ। অনেকে পাহাড়ে ট্রাভেলিং করতে গিয়ে অনেক সময় ঝিরির পাশে বা ঝর্ণার পাশে ক্যাম্প করি । বর্ষায় এসব অঞ্চলে ক্যাম্প করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
কীভাবে কমানো যায় পানিতে প্রাণহানির ঝুঁকি?
আমাদের দেশ মূলত নদীমাতৃক প্রায় প্রতিটি জেলায়ই নদীসহ রয়েছে আরও অনেক জলাশয়। আমরা যদি পানির সাথে বেচে থাকার বেসিক বিষয়গুলো জেনে নেই তাহলে ভ্রমণে অথবা ভ্রমণ ছাড়াও পানিতে মৃত্যু হার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। চলুন জেনে নেই কীভাবে আমরা পানিতে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে পারি।
১. নিজের জন্য সাঁতার শেখা বাধ্যতামূলক করুন
সাঁতার বিলাসিতা নয়। নদীমাতৃক এই দেশে এটি একটি অপরিহার্য জীবন দক্ষতা। পরিবার, গ্রাম, মহল্লা, স্কুল, ক্লাব সবাই মিলে এই উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারের ও এগিয়ে আসা উচিত।
২. ট্রাভেলিং করা অথবা পানিতে নামার আগে নির্দিষ্ট এলাকার পানির প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা
আমরা সাগর, নদী, ঝর্ণা বা হাওর- বাওড় যেখানেই যাই না কেন। পানির প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান থাকা অত্যন্ত দরকারি একটি বিষয়। ঝিরি, সাগর, নদী বা জলপ্রবাহ কখনোই সাধারণ পুকুর বা সুইমিংপুল নয়। এগুলোতে পানির গভীরতা ও স্রোতের গতি মুহূর্তেই বদলে যেতে পারে। স্রোতের নিচে ফাঁদ থাকে, থাকে ডিপ হোল বা সাকশন, যা অভিজ্ঞ সুইমারকেও বিপদে ফেলতে পারে।
আমরা যদি বোঝার চেষ্টা করি কোথায় স্রোতের ফাঁদ বা ডিপ হোল (ডিপ হোল হলো পানির নিচে থাকা হঠাৎ অতিরিক্ত গভীর জায়গা) বা সাকসান (যেখানে পানি ঘুরতে থাকে এবং মাঝখানে টেনে নেয়)। অনেকে এইটিকে চোরা গর্ত, ঘূর্ণি ফাঁদও বলে থাকেন। বর্ষাকালে বেশিরভাগ নদীতে ভয়ঙ্কর মৃত্যু ফাঁদটি দেখা যায়। কোথায় কোন নদীতে এই ফাঁদটি আছে বা থাকতে পারে তা যদি আমাদের ধারণা থাকে তাহলে আমরা খুব সহজেই এই বিষয়গুলো এড়িয়ে চলতে পারব। পানিতে আরও একটি মৃত্যুর মূল কারণ হলো স্রোতের ফাঁদ। এটি হলো এমন একটি বিষয় যা অনেক সময় উপর থেকে দেখে বোঝার উপায় থাকে না। কিন্তু পানিতে থাকে তীব্র টান। শান্ত পানি ভেবে এই পানিতে নামলেই আপনি ভেসে যেতে পারেন গভীরে। আবার অনেক সময় ঘোলা পানিতে এইগুলো বোঝার উপায় থাকেন তাই অবশ্যই বৃষ্টি হচ্ছে, বা পানি ঘোলা এই সময় পানিতে নামা একেবারেই উচিত নয়। একান্তই দরকার পড়লে নামলেও লাইভ জ্যাকেট, উইসেল, রোপ সাথে রাখা উচিত। পানির গতি প্রকৃতি সম্পর্কে স্থানীয় অভিজ্ঞ লোক বা স্থানীয়দের থেকে জেনে নিতে পারেন।
৩. সাতারে শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার অনুশীলন করুন
ধরুন আপনি সাঁতার জানেন। আপনার মনে হতে পরে ছোটবেলা থেকে সাঁতার কাটছি। নদী নালা এক তুড়িতেই পার করে ফেলব। এটা ভেবে যদি আপনি আপনি পানিতে নেমে পড়েন, জেনে রাখুন আপনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আপনি যদি সাগরে, নদী-নালা বা যেকোনো জলাশয়ে সাঁতার কাটতে চান তাহলে অবশ্যই আপনার বেসিক কিছু প্রশিক্ষণ নেয়া উচিত। এর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে সাঁতারের সময় শ্বাস নেয়া ও ছাড়ার কৌশল। এই সহজ বিষয়টি রপ্ত করতে পারলে আর যাই হোক আপনি যেকোনো পরিস্থিতিতে দীর্ঘক্ষণ পানিতে ভেসে থাকতে পারবেন। সাঁতারের সময় শরীরের ভেতর তৈরি হাওয়া কার্বন ডাই-অক্সাইড ছেড়ে অক্সিজেন নিতে পাড়ার সাধারণ এই কৌশলটি হতে পরে আপনার সারাজীবনের জন্য জীবন রক্ষাকারী একটি বিশেষ স্কিল। আপনি যখন জানবেন যে, আপনি আর যাই হোক দীর্ঘক্ষণ ভেসে থাকতে পারবেন তখন আর আপনি প্যানিক করবেন না এবং ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে। এটা নিশ্চিত ভাবেই পানির এক্সট্রিম সিটিউসনে আপনাকে দীর্ঘক্ষণ টিকিয়ে রাখবে।
৪. নিয়ম মানুন ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার করুন
বর্ষায় নদী পথে বা পানির কাছাকাছি ট্রাভেলিংয়ে অবশ্যই চোখ কান খোলা রাখতে হবে। বিশেষ করে যদি এলাকাটিতে কোনো জলাশয় থাকে তাহলে অবশ্যই আপনাকে লাইফ জ্যাকেট, হুইসেল, ও রোপ নিতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় লাফানো বা সাঁতার অবশ্যই পরিহার করতে হবে। ছবি তোলার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখবেন যেন বেপরোয়া হয়ে না যান।
৫. প্রশিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ লোকদের পরামর্শ শুনুন
স্থানীয় অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত গাইড, লাইফগার্ড অথবা ওপেন ওয়াটার সুইমারদের পরামর্শ নিতে পারেন। স্থানীয়রা অনেক কিছু জানেন তাই তাদের পরামর্শ খুবই মূল্যবান। ওপেন ওয়াটার সুইমাররা জানেন কীভাবে দীর্ঘক্ষণ মাথা ঠাণ্ডা রেখে ভেসে থাকতে হয়। তাই নদী, সমুদ্র, ঝিরি, হাওয়ার বাওরে ট্রাভেলিং করতে গেলে তাদের পরামর্শ নিতে পারেন।
৬. শিশুদের জন্য করণীয়
কোনো অবস্থাতেই সাথে থাকা শিশুকে একা ছাড়বেন না। পানিতে নামতে দেয়া পরিহার করুণ। এবং অবশ্যই পরিবারের সদস্যদের সাথে নিয়ে বের হবেন।
বর্ষায় যদি পাহাড়ে ট্র্যাকিং করার কথা ভাবেন তাহলে যেই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে।
বর্ষায় ট্র্যাকিং পরিহার করা উত্তম। একান্তই দরকার হলে এই বিষয়গুলো অবশ্যই মাথায় রাখা উচিত।
- একটা কথা মাথায় রাখতে হবে পাহাড়ে আপনার পাশে বৃষ্টি না হলেও ঢল আসতে পারে যখন তখন।
- আবহাওয়ার পূর্বাভাস জেনে বের হতে পারেন।
- খাল, ঝর্ণা বা নদীর পাশে ক্যাম্প করার আগে হাজারবার ভাবুন।
- অবশ্যই উঁচু ও নিরাপদ স্থানে বিশ্রাম নিন।
- স্থানীয়দের পরামর্শ অবশ্যই নিন।
- গভীর ঝিরিতে হাঁটা এড়িয়ে চলুন।
- ঝর্ণার নিচে দীর্ঘসময় অবস্থান করবেন না।
- সুরক্ষিত গিয়ার (লাইফ জ্যাকেট, হুইসেল) সাথে রাখুন।
- কখনোই একা ট্র্যাকিং করবেন না। দল বেধে ট্র্যাকিং করুণ।
হঠাৎ ফ্ল্যাশ ফ্লাড এলে কখনোই খালের ওপর দিয়ে দৌড়ে পালাবেন না, পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবেন না এবং মোবাইল বা ব্যাগ বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলবেন না।
শেষ কথা
সাঁতার জানলেও বাঁচা যায় না, যদি পানির আচরণ না জানা থাকে। আবার সাঁতার না জানলেও পানি মৃত্যু থেকে নিজেকে বাচিয়ে রাখা যায়।
সাঁতার জানলেও আপনি বর্ষায় এবং বাঁচিয়ে ঘোলা পানিতে সাঁতার পরিহার করুণ। সতর্ক থাকুন, নিয়ম মানুন, নিজে বাঁচুন— অন্যকেও বাঁচান।
সরকারের এ বিষয়ে এগিয়ে আশা উচিত। দেশে সুইমিং শেখার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই এবং এটাও পানি মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ।
লেখক: নাসির আহমেদ। ট্রাভেলার, ওপেন ওয়াটার সুইমার; প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ওপেন ওয়াটার সুইমিং।