ভূমি মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন (Land Offence Prevention and Remedy Act), ভূমি ব্যবস্থাপনার ডিজিটাল অটোমেশন (Digital Land Automation) এবং স্মার্ট ভূমি সেবা নিশ্চিত করতেই এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
একনজরে: ২০২৬ সালের ভূমি আইনের পরিবর্তন
- কার্যকর তারিখ: ১ জানুয়ারি ২০২৬।
- মূল লক্ষ্য: জালিয়াতি রোধ, ভূমি অপরাধ দমন ও ডিজিটাল অটোমেশন (Digital Automation) নিশ্চিত করা।
- বাতিল হবে যেসব মালিকানা: ভুয়া দলিল, খাস জমির অবৈধ কেনাবেচা, অর্পিত সম্পত্তির জাল দলিল এবং অতিরিক্ত জমি রেজিস্ট্রি।
- ওয়ারিশদের অধিকার: ভাই-বোন বা অন্য উত্তরাধিকারীদের বঞ্চিত করে নামজারি বা রেকর্ড করলে তা সরাসরি বাতিলযোগ্য হবে।
- পৈতৃক সম্পত্তি: পৈতৃক সম্পত্তির ক্ষেত্রে নিজের অংশের চেয়ে বেশি বিক্রি করলে সেই দলিলের কোনো আইনি ভিত্তি থাকবে না।
- ডিজিটাল নিরাপত্তা: হাতে লেখা খতিয়ানের বদলে কিউআর কোড (QR Code) যুক্ত স্মার্ট পর্চা ও নামজারি বাধ্যতামূলক।
- শাস্তি: নতুন আইনে জাল দলিল বা অবৈধ দখলের জন্য জেল ও অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
- পরামর্শ: জমি নিয়ে বিরোধ থাকলে দ্রুত সমাধান করুন এবং ১৬১২২ (Land Hotline) নম্বরে কল করে সহায়তা নিন।
বাতিল হতে যাওয়া ৬ ধরনের দলিলের বিস্তারিত বিশ্লেষণ (Detailed Analysis of Invalid Documents)
১. জাল বা ভুয়া দলিল (Ownership Based on Fake or Forged Deed): দীর্ঘদিন ধরে প্রতারক চক্র ভুয়া এনআইডি (Fake NID) ও মৃত ব্যক্তির জাল সই ব্যবহার করে জমি লিখে নিত। ২০২৬ সাল থেকে ডাটাবেজে দলিলের মিল না থাকলে সেই মালিকানা সরাসরি বাতিল হবে। এ ধরনের অপরাধে জেল ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
২. চুক্তির চেয়ে বেশি জমি রেজিস্ট্রি (Registering Excess Land than Deed): অনেকে ৩০ শতাংশ জমি কিনে কৌশলে দলিলে ৩৫ শতাংশ লিখে নেন। এই অতিরিক্ত ৫ শতাংশ জমি এখন থেকে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। সফটওয়্যারের মাধ্যমে জমির আগের খতিয়ান ও বর্তমান দলিলের তথ্যের অমিল পাওয়া গেলেই বাড়তি অংশের মালিকানা বাতিল করে প্রকৃত মালিককে ফেরত দেওয়া হবে।
৩. ওয়ারিশ ঠকিয়ে করা রেকর্ড (Land Record Depriving Heirs): পৈতৃক সম্পত্তিতে ভাই-বোন বা নিকটাত্মীয়দের বঞ্চিত করে যারা নিজের নামে আরএস রেকর্ড (RS Record) বা নামজারি করে নিয়েছেন, তাদের জন্য সময়টা কঠিন হতে যাচ্ছে। আদালতের মাধ্যমে জালিয়াতি প্রমাণিত হলে সেই রেকর্ড বাতিল হবে এবং বঞ্চিত ওয়ারিশরা তাদের আইনগত অধিকার ফিরে পাবেন।
৪. খাস জমির বেআইনি কেনাবেচা (Illegal Transaction of Khas Land): সরকারি খাস জমি সাধারণত ভূমিহীনদের বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। কিন্তু অনেকে এসব জমি অবৈধভাবে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করে দেন। আইন অনুযায়ী, খাস জমি ক্রয়-বিক্রয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ২০২৬ থেকে এ ধরনের সকল দলিল বাতিল বলে গণ্য হবে এবং ভূমিটি সরকারি হেফাজতে চলে যাবে।
৫. অর্পিত বা পরিত্যক্ত সম্পত্তির জাল দলিল (Vested or Abandoned Property Fraud): ১৯৬৫ বা ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে দেশ ছেড়ে যাওয়া ব্যক্তিদের সম্পত্তি (Vested Property) নিয়ে ব্যাপক জালিয়াতি হয়েছে। এখন থেকে এসব জমির মালিকানা দাবি করতে হলে নিশ্ছিদ্র প্রমাণের প্রয়োজন হবে। ভুয়া দলিল দিয়ে অর্পিত সম্পত্তির মালিকানা দাবি করলে তা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
৬. অংশের অতিরিক্ত পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি (Selling Excess Ancestral Property): ওয়ারিশ সূত্রে একজন যতটুকু জমির মালিক, তার চেয়ে বেশি জমি বিক্রি করলে সেই দলিল কখনোই কার্যকর হবে না। এমনকি যিনি বেশি জমি কিনবেন, তিনিও কোনো মালিকানা পাবেন না। মনে রাখতে হবে, পৈতৃক সম্পত্তি ১০০ বছর পরেও আইনি প্রক্রিয়ায় উদ্ধার করা সম্ভব।
ভূমি আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২৬ সালের শুরু থেকেই ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল অটোমেশন (Digital Automation) পুরোপুরি কার্যকর হবে। ফলে কোনো অবৈধ দলিল দিয়ে পার পাওয়ার সুযোগ থাকবে না। যাদের জমিতে এ ধরনের জটিলতা রয়েছে, তাদের দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা বা আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
,কেন এই কঠোর পরিবর্তন? (Rationale Behind the Change)
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে দেশের দেওয়ানি মামলার প্রায় ৭৫ শতাংশই জমি সংক্রান্ত। এই মামলাগুলোর প্রধান কারণ ভুয়া দলিল ও অবৈধ দখল। ২০২৬ সাল থেকে স্মার্ট ভূমি রেকর্ড (Smart Land Record) ও অনলাইনে জমির মালিকানা ট্র্যাকিং ব্যবস্থা চালুর ফলে জালিয়াতির পথ বন্ধ হবে। প্রতিটি মৌজার ম্যাপ এবং খতিয়ান ডিজিটাল হওয়ায় কেউ চাইলে অন্যের জমি নিজের বলে দাবি করতে পারবে না।
ভূমি আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাদের জমির দলিলে বা রেকর্ডে ত্রুটি আছে, তাদের দ্রুত সংশোধন (Correction) করা উচিত। বিশেষ করে:
- দ্রুত নামজারি বা মিউটেশন (E-Mutation) সম্পন্ন করুন।
- খতিয়ানে ভুল থাকলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা এসি ল্যান্ড অফিসে যোগাযোগ করে সংশোধনের আবেদন করুন।
- পৈতৃক সম্পত্তির ক্ষেত্রে অংশীদারদের মধ্যে বন্টননামা দলিল (Partition Deed) সম্পন্ন করে নিন।
আরও পড়ুন:
ভূমি আইন নিয়ে প্রত্যেক জমির মালিকের জানা উচিত
পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বা আমমোক্তারনামা যাচাই (Verification of Power of Attorney): অনেক ক্ষেত্রে প্রবাসীদের জমি জাল 'পাওয়ার অব অ্যাটর্নি'র মাধ্যমে বিক্রি করে দেওয়া হয়। ২০২৬ সাল থেকে যেকোনো আমমোক্তারনামা দলিলের মাধ্যমে জমি রেজিস্ট্রির আগে সেটি সরাসরি ডিজিটাল ডাটাবেজ থেকে যাচাই করা বাধ্যতামূলক হবে।
বায়না দলিলের সময়সীমা (Time Limit for Bayna Deed): বায়না দলিল করার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (সাধারণত ১২ মাস) জমি রেজিস্ট্রি না করলে সেই বায়না দলিলের কোনো আইনি ভিত্তি থাকবে না। অনেকেই বছরের পর বছর বায়না ধরে রেখে জমি আটকে রাখেন, যা ২০২৬ থেকে আর সম্ভব হবে না।
জমির দখল বনাম দলিল (Possession vs Document): নতুন আইনে 'জোর যার মুল্লুক তার' নীতি আর চলবে না। শুধুমাত্র দলিলে নাম থাকলেই হবে না, যদি আপনার দখল বেআইনি প্রমাণিত হয়, তবে নতুন আইনে ফৌজদারি অপরাধে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
ই-নামজারি ও কিউআর কোড (E-Mutation & QR Code): এখন থেকে হাতে লেখা কোনো নামজারি বা পর্চা গ্রহণ করা হবে না। ২০২৬ সালের মধ্যে সকল জমির খতিয়ানে কিউআর কোড (QR Code) যুক্ত থাকবে, যা স্ক্যান করলেই মালিকের আসল পরিচয় মুহূর্তেই জানা যাবে।
ভূমি উন্নয়ন কর (Land Development Tax): যারা বছরের পর বছর জমির খাজনা বা কর দেন না, ডিজিটাল সিস্টেমে তাদের মালিকানা স্বয়ংক্রিয়ভাবে 'সন্দেহভাজন' তালিকায় চলে যেতে পারে। তাই নিয়মিত অনলাইন ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করে রশিদ সংগ্রহ করা জরুরি।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের এই কঠোর পদক্ষেপ মূলত সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষায় নেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল অটোমেশন ও নতুন ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন কার্যকর হলে মধ্যস্বত্বভোগী ও জালিয়াতি চক্রের দৌরাত্ম্য চিরতরে বন্ধ হবে। তবে যাদের দলিলে সামান্য ত্রুটি বা রেকর্ডে অনিয়ম রয়েছে, তাদের জন্য সময়টা চ্যালেঞ্জিং। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২৬ সালের জানুয়ারি মাস আসার আগেই জমি সংক্রান্ত সকল বিরোধ নিষ্পত্তি এবং কাগজপত্র হালনাগাদ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। অন্যথায়, আদালতের দীর্ঘসূত্রিতা এবং আইনি মারপ্যাঁচে মালিকানা হারানোর ঝুঁকি থেকেই যাবে। মনে রাখবেন, আধুনিক ভূমি ব্যবস্থাপনায় 'দলিল যার, জমিও তার'—এই নীতিকে আরও শক্তিশালী ও নিশ্ছিদ্র করা হচ্ছে।





