ভিসা বন্ধ দিয়ে শুরু এরপর দূতাবাসে হামলা, সীমান্ত উত্তেজনা, ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল, আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ— ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে এভাবেই টানাপোড়েন চলছে ভারতের। যার সবশেষ সংযোজন ‘পুশ ইন’।
আগের বৈঠকগুলোতে দু’দেশেরই যে বক্তব্য, ভালো সম্পর্ক চাওয়া, ন্যায্যতার সম্পর্ক তৈরি করা, তা থেকে যাচ্ছে কথাতেই। বিজিবি-বিএসএফের দফায় দফায় পতাকা বৈঠক, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একাধিক কূটনৈতিক বার্তা পাঠিয়েও কোনো কাজ হয়নি। উল্টো বেড়েছে ‘পুশ ইন’।
প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো সীমান্ত দিয়ে নারী-পুরুষ-শিশুকে বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে ভারত। পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে তাই বলতে হয়েছে ঠেকানো যাচ্ছে না ‘পুশ ইন’।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, পুশ ইন হচ্ছে। সেটা কিন্তু ফিজিক্যালি ঠেকানো সম্ভব না আসলে।’
১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশনের ৩৩ এর ১ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে এমন দেশে পাঠানো যাবে না যেখানে তার প্রাণ বা স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়বে। ইউরোপীয় মানবাধিকার কনভেনশনের প্রোটোকল ৪ অনুযায়ী, শরণার্থীদের সমষ্টিগত বহিষ্কার নিষিদ্ধ।
অথচ ‘পুশ ইন’ প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিদের কোনো আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই ঠেলে দেয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা একে আন্তর্জাতিক আইন, কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন বলছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওবায়দুল হক বলেন, ‘ভারত যে প্রক্রিয়ায় এ তথাকথিত পুশ ইন করছে বাংলাদেশে, সেটি আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সেই সাথে এটি কুটনৈতিক শিষ্টাচার এবং মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন। কোনো দেশই রাতের অন্ধকারে এ রকম একদল মানুষকে সীমান্তে ঠেলে দিতে পারে না।’
সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে ব্যবহার করে পুশ ইনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে চাপে রাখা ভারতের নতুন কৌশল বলছেন এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক। তার মত, এই সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক মহলকে যুক্ত করতে হবে।
অধ্যাপক ওবায়দুল হক আরো বলেন, ‘আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরতে পারি। ভারত যেভাবে আমাদের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে, আমরাও সেরকমভাবে আন্তর্জাতিক মহলে বিষয়টি তুলে ধরার মাধ্যমে তাদের চাপে রাখতে পারি।’
‘পুশ ইন’ রোধে ইতোমধ্যেই বিজিবি সীমান্তে গোয়েন্দা নজরদারি ও টহল তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে। তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘পুশ ইন’ ঠেকাতে বিজিবির সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দেখাতে হবে দৃঢ়তাও। প্রয়োজনে ‘পুশ ব্যাক’ করতে হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. নাসির উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘দৃঢ়তার সঙ্গে তাদেরকে বলতে হবে যে, কোনো অবস্থাতেই তোমরা এভাবে পুশ ইন করতে পারো না। এটা মানবতা বা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। এটাতে কাজ না হলে নির্দিষ্ট পন্থায় তাদেরকে আবার পুশ ব্যাক করতে হবে। এতে তারা বুঝে যাবে যে, এভাবে সফল হতে পারবে না তারা।’
কোনো দেশের নাগরিক অবৈধভাবে অন্য দেশে থাকলে, তাকে ফেরত পাঠানোর সুনির্দিষ্ট পন্থা আছে। কিন্তু পুশ ইন বাড়তে থাকায় তা ঢাকা-দিল্লীর চলতি সম্পর্কে বাড়াচ্ছে অস্বস্তি।
ড. নাসির উদ্দিন আহম্মেদ আরো বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আইন বা মানবাধিকারের প্রতি যদি তাদের শ্রদ্ধাবোধ থাকতো, তাহলে তাদেরকে এভাবে পুশ ইন করতো না। এরকম চলতে থাকলে দু’দেশের মধ্যে একটা আস্থার সংকট হয়, যেটা আমাদের মধ্যে এখন তৈরি হয়েছে।’
গেলো ৭ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত ৩৮ দিনে প্রায় ২ হাজার পুশ ইনের ঘটনা ঘটেছে।