মায়ের বুকে সন্তানের ফিরে আসা। ভয়ংকর নির্যাতন আর জিম্মি দশা থেকে মুক্তি পেয়ে এমন ফেরা যেন স্বপ্নের মতোই।
ইতালি যাওয়ার হাতছানিতে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দেশ ছেড়েছিলেন মুন্সীগঞ্জের রিপন শিকদার ও গাজীপুরের মাসুম মোল্লা। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ইউরোপের দুয়ার পেরোনোর আগেই প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে পাচার হন লেবাননে। ক্যাম্পে বন্দী রেখে শুরু হয় দুঃসহ নির্যাতন। জিম্মি করে, নির্যাতনের ভিডিও পরিবারের কাছে পাঠিয়ে আদায় করা হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ।
দিনের পর দিন প্রতারক চক্রকে প্রায় ৭০ লাখ টাকা দিয়েও নির্যাতন থেকে নিস্তার মেলেনি।
এমন বাস্তবতায় তাদের করুণ কাহিনী তুলে ধরা হয় এখন টেলিভিশনে। সংবাদ প্রচারের পর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্রাক ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-আইওএমের যৌথ উদ্যোগে মুক্তি পান এই দুই ভুক্তভোগী। প্রায় দেড় বছর নির্মম বন্দীজীবনের অবসান ঘটে তাদের।
লিবিয়ার ত্রিপোলি থেকে ২১ জুন বাংলাদেশে পৌঁছান তারা। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন দুই ভুক্তভোগী। তাদের অভিযোগ, দালাল চক্রের প্রধান মোজাম্মেল, নওশাদ, নজরুল, সোহাগ ও হাওলাদার ট্রাভেলস কোম্পানি এ ঘটনার মূল হোতা।
ভুক্তভোগীদের মধ্যে একজন বলেন, ‘জিয়ার ক্যাম্পে নিছে ওখান থেকে মার শুরু করছে। খাবার দেয় না, খাবারের জন্য আমরা বলতাম ভাই একটু খাবার দেন, খাবার দিতো না। কান্না করতাম, কন্না করে অনেকসময় আব্বাকে বলতাম যে, আব্বা আমার জানটা একটু ভিক্ষা দেন আপনি। আবার বাপের এখন কিছু নাই। আমার জন্য সব বিক্রি করে দিছে।’
অন্য একজন বলেন, ‘আমি অনেকদিন নিখোঁজ ছিলাম। আমাদের পরিবার জানে না আমরা বেঁচে আছি, না মরে গেছি। তারপর আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, আপনারা যেরকম নিউজ দিয়েছেন তার মাধ্যমে একটা মামলা হয়েছে, সেই মামলার মাধ্যমে আমাদের দেশে আনার পরিকল্পনা নিয়েছিল। কিন্তু ওরা বলছে যে না, এরকমভাবে হবে না। যদি স্ট্যাম্পে সাইন দাও তাহলে তোমাদের দেশে আনা হবে।’
ভুক্তভোগীর স্বজনরা বলছেন, সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে বিদেশে কাজ দেয়ার নামে পাচার করা হয় তাদের সন্তানদের। জিম্মি করে হাতিয়ে নেয়া অর্থ আর পাশবিক অত্যাচারের বিচার দাবি করেন তারা।
কজন ভুক্তভোগীর বাবা বলেন, ‘আমি সুষ্ঠু বিচার চাই। আমার ছেলে জীবনটা আমি ভিক্ষা পাইছি। আমার টাকা পয়সা সবকিছু মিলে যে ক্ষতি হয়েছে আমি যেন ওর থেকে সব ফিরে পাই। এটা বাংলাদেশ সরকারের কাছে আকুল আবেদন, এটা আমি চাই।’
ভুক্তভোগীর মা বলেন, ‘বিনা দোষে, বিনা অপরাধে আমার ছেলেরে এভাবে মারছে, আল্লাহ যেন ওদের বিচার করে। আমি আল্লাহর কাছে বিচার চাই।’
ইউরোপের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা ফ্রন্টেক্সের তথ্য বলছে, লেবানন হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে সবচেয়ে বেশি ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করে বাংলাদেশিরা। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই রুটে প্রায় ৭০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি ইউরোপে প্রবেশ।
লিবিয়া ফেরত ৫৫৭ জনের বাংলাদেশির তথ্য বিশ্লেষণ করে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক বলেছে, তাদের ৬০ শতাংশের পরিবারকে স্থানীয় দালালরা প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে যায়। যাদের ৮৯ শতাংশই নানা ঝুঁকিতে পড়েছেন। প্রতিবেদন আরও বলছে, লিবিয়া হয়ে ইউরোপ যাওয়ার পথে ৯৩ শতাংশই ক্যাম্পে বন্দী হয়েছেন আর ৭৯ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশ যাওয়ার স্বপ্নযাত্রা যেন মৃত্যুযাত্রায় পরিণত না হয়, তার জন্য সচেতনতা যেমন জরুরি, তেমনি এই সংকট কাটাতে দালাল চক্রের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনের প্রয়োগ প্রয়োজন।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রেগ্রামের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য এটা খুবই ভয়াবহ সংকটগুলোর কারণে এটা আমাদের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ করে। ভীষণ দুঃখজনক হলো, যে মানুষগুলো অভিযোগ করে, ফেরত আসে তারা কিন্তু সবাই জেনেশুনে এগুলো করে। জানে যে এভাবে যেতে হবে। তারা রীতিমতো এটাকে এক ধরনের গেম মনে করে। কিছুদিন আগে অন্তত ২৫ জন বাংলাদেশির মরদেহ পচে গলে ফেরত আসছে সৈকতে। কাজেই আমি মনে করি ফেরত আসার পর বা বিপদে পড়ার চেয়ে যাওয়ার আগেই সচেতনতাটা বেশি জরুরি।’
নির্মমতায় হাঁপিয়ে ওঠা জীবন থেকে মুক্তি মিললেও মানসিকভাবে দুঃস্বপ্ন তাড়িয়ে বেড়ায় নির্যাতিত প্রবাসীদের। এমন করুণ বাস্তবতায় যেন পর্যবসিত হতে না হয় তার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের।