মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি: মানবিক বিপর্যয় হারিয়েছে গুজবের মিছিলে!

মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের প্রধান ফটকে শোকের ব্যানার
মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের প্রধান ফটকে শোকের ব্যানার | ছবি: সংগৃহীত
1

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি মানুষ মনে রাখবে অনেক দিন। কিন্তু সেই সঙ্গে মনে রাখবে মর্মস্পর্শী এ ঘটনা নিয়ে ছড়িয়ে পড়া অপতথ্য ও গুজবের ঘটনাকেও। জীবন বাজি রেখে এ দুর্যোগে যারা উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করেছেন, মরদেহ গুমের গুজব ছড়ানো হয়েছে সেসব সংস্থা ও বাহিনীর বিরুদ্ধে। খানিকটা দেরি হলেও, আহত-নিহত শিক্ষার্থীদের হিসাব তুলে ধরছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। উদ্ধার অভিযানে ভূমিকা রাখা কর্মকর্তারা বলছেন, এমন অপপ্রচার দুঃখজনক। সবমিলিয়ে এ মানবিক বিপর্যয়ে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্ব পাচ্ছে তথ্য ব্যবস্থাপনার আলাপও।

হতাহতের সংখ্যা হয়তো আরও বেশি হতে পারতো, যদি ততক্ষণে স্কুল ছুটি না হতো।

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ আশপাশের বেশকিছু সিসিটিভি ফুটেজ, স্কুল কর্তৃপক্ষ, প্রত্যক্ষদর্শী, ছাত্র-শিক্ষক ও সেনাসদস্যদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে এটা বলা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হায়দার আলী ভবনে এফ সেভেন যুদ্ধবিমান আছড়ে পড়ার সময়টা ২১ জুলাই দুপুর ১টা বেজে ১২ মিনিট। যার মাত্র ১২ মিনিট আগে ঐ ভবনের শ্রেণিকক্ষগুলোর ছুটি হয়েছিল।

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, যুদ্ধবিমানটি বিধ্বস্ত হবার পরপর, মাঠে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের ভীত সন্ত্রস্ত ছুটাছুটি। কিন্তু কিছু শিক্ষার্থী তো ছিলো, অপেক্ষারত কিংবা শ্রেণিত্তোর কার্যক্রমে।

শহরের ইতিহাসে এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় যখন শোকে মুহ্যমান পুরো জাতি, তখন এ ঘটনাকে নিয়ে ভেসে চলছে নানা-গুজব, অপতথ্য। দোতলা ভবনটির ‘স্কাই’ এবং ‘ক্লাউড’ ক্লাসরুম মর্মান্তিক সে ঘটনার স্মৃতি হয়ে আছে।

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ১০০ গজ দূরে ৪৩ সোরাড মিসাইল রেজিমেন্টের আর্মি ক্যাম্প। আকস্মিক এ ঘটনায় প্রথম সাড়া দেন তারা। লেফট্যানেন্ট কর্নেল তাহসিন হক চৌধুরী ব্যাখ্যা করছিলেন, তারা এতটা দ্রুত এজন্যই সাড়া দিতে পেরেছিলেন, কারণ তখন ঐ ইউনিটটির দরবার চলছিলো, তার মানে একসঙ্গে প্রস্তুত প্রায় ১০০ সেনাসদস্য।

৪৩ সোরাড মিসাইল রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাহসিন হক চৌধুরী বলেন, ‘ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে দেখেছি রাস্তার মধ্যে বিভিন্ন মৃতদেহ পড়েছিল। এদের কারো কারো হাত-পা শরীরের বিভিন্ন অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আমাদের সেনাসদস্যরা মানুষ এবং মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তাদের গায়ের ইউনিফর্ম খুলে মৃতদেহের ওপর বিছিয়ে দিয়েছিলেন।’

সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়, ৩টি বিষয়কে মাথায় রেখে তারা উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করছিলো, যার অন্যতম পুনঃবিস্ফোরণের শঙ্কা। এবং তারা এটাও বলছে, শতশত মানুষ, গণমাধ্যমকর্মীদের ক্যামেরার সামনে তাদের কাজে সমানভাবে সহায়তা করেছে স্কুলের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীসহ, ফায়ার সার্ভিস এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী। এবং সবপক্ষ স্বীকার করছে, দুপুর সোয়া একটা থেকে রাত সাড়ে ৭টা পর্যন্ত সেনাবাহিনী সক্রিয়ভাবে শুধু উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। প্রশ্ন ছিলো, এরপর কী সেনাবাহিনী আর দুর্ঘটনা কবলিত স্কুল প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেছিলো, বিশেষ করে ঐ রাতে?

লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাহসিন হক চৌধুরী বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, ঘটনার দিন বিশেষ করে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার পর কোনোপ্রকার আর্মি উত্তরা মাইলস্টোন কলেজে প্রবেশ করেনি। আমরা শুধু উদ্ধারের দায়িত্বটা পালন করেছি। এবং যেকোনো ধরনের মিথ্যা তথ্য বা অপতথ্য আমাদের স্পিরিট বা প্রফেশনালিজমকে কখনোই আক্রান্ত করবে না।’

বস্তুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা অপতথ্য ভেসে বেড়ালেও মাইলস্টোন স্কুল থেকে বের হবার রাস্তা একটাই। এবং মরদেহ গুম বা এরকম কোনো ঘটনারও প্রমাণ মেলে নি। বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য দুইটি ব্যাপার হলো, স্কুল কর্তৃপক্ষও বলছে আর কেউ নিখোঁজ নেই এবং অভিভাবকদেরও ব্যাপকভাবে এ ব্যাপারে দাবি জানাতে দেখা যায় নি। তাহলে শতশত লাশ গুম এমন তথ্য কেন আসছে?

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জিয়াউল আলম বলেন, ‘আমি জানি না কারা এ তথ্য প্রচার করছে। কীভাবে প্রচার করছে। তারা এ সংখ্যা কোথা থেকে পেয়েছে আমি জানি না। অনেক সংবাদ অনেকদিক থেকে আসছে। আমি সেদিকে কোনো খেয়াল করছি না। আমি আমার কাজটা ঠিকমতো করছি।’

বস্তুত বাকি ৬টি মরদেহের মধ্য থেকে অসনাক্ত ৫টি মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়, রাতেই, এ মর্গ থেকেই। এদের মধ্যে রাইসা মনি, ওকিয়া ফেরদৌস নিধি, মারিয়াম উম্মে আফিয়াসহ ৯ বছরের ৩ শিশু এবং ২৮ বছরের দুই জন নারী রয়েছেন।

মাইলস্টোন ট্রাজেডিতে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত পর্যন্ত সরকার ৩১ জনের মৃতের ঘটনা নিশ্চিত করেছে। এ ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ ১১ জন ঢাকা সিএমএইচের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন আছেন যেখানে জাতীয় বার্ন ইন্সটিটিউটে আছেন অন্তত ৪২ জন।

সবপক্ষের এত আন্তরিকতার পরও, এভাবে নিরাপত্তাবাহিনীসহ নানা সংস্থার বিরুদ্ধে অপতথ্য ছড়িয়ে পড়ার কারণ কী কিংবা এসব প্রতিরোধে সামনে করণীয় কী এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ডিসমিস ল্যাবের রিসার্চ অফিসার তামারা ইয়াসমীন তমা বলেন, ‘যারা শেয়ার করছেন তারা কিন্তু আবেগ তাড়িত হয়েই শেয়ার করছেন। এ কারণে পুরো জিনিসটা আরও এমপ্লিফাই হচ্ছে। এরকম ক্ষেত্রে যা দরকার তা হলো যারা এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত আছেন তারা যেন স্বচ্ছভাবে নিয়মিত ব্রিফিং ও হালনাগাদ তথ্যটা সবার সাথে শেয়ার করেন।’

সব মিলিয়ে এটা বলা যায়, ঢাকার মাটিতে এভাবে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়া এবং সেটি থেকে শিশু শিক্ষার্থীদের ব্যাপকভাবে অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ঘটনা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্ব বাড়ছে তথ্য ব্যবস্থাপনারও।

ইএ