ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন দেশ বিনির্মাণে সংস্কার আলোচনার শেষ দিনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক, কখনও উত্তপ্ত, কখনও সৌহার্দ্য।
মাসব্যাপী বৈঠকের শেষদিনে ঠেকেছে অমীমাংসিত ৭টি বিষয়। দিনভর চুলচেরা বিশ্লেষণ, যুক্তি-পাল্টা যুক্তি, প্রস্তাব— এসব মৌলিক ইস্যুতে আগেও একাধিক আলোচনা হয়েছে, কিন্তু সিদ্ধান্ত হয়নি। এদিকে জুলাই সনদ দেয়ার সময়ও ফুরিয়ে আসছে, তাই কমিশনের তাড়াহুড়ো।
বরাবরের মতো ভোটের অনুপাত নয়, বরং আসনের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ গঠন চায় বিএনপিসহ কয়েকটি দল। অন্যদিকে কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী ভোটের অনুপাতে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে উচ্চকক্ষ চায় জামায়াত ও এনসিপিসহ বেশকটি দল।
তাদের দাবি, নিম্নকক্ষের আসনের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ গঠন হলে, আরেকটা শোভাবর্ধন অকার্যকর প্রতিষ্ঠান হবে। এ সুযোগে বিএনপিসহ কয়েকটি দল উচ্চকক্ষের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তখন উত্তেজনা তৈরি হয় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে কমিশনের ২৩তম বৈঠকে। তখন দুপুরের বিরতি দেয় ঐকমত্য কমিশন।
বিরতির পর, ঐকমত্য কমিশন সিদ্ধান্ত দেয় জনগণের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষ গঠন হবে। তবে নোট অব ডিসেন্ট দেয় বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল।
দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান— দুদক, পিএসসি, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও ন্যায়পালের নিয়োগ আইন সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত দেয় কমিশন। তবে এই সিদ্ধান্তেও নোট অব ডিসেন্ট দেয় বিএনপিসহ পাঁচটি দল ও জোট।
এদিন নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষের সদস্যের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়।
গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক সংস্কার ইস্যুতে সমঝোতা না হওয়ায় আরো সময় বাড়াতে কমিশনের প্রতি আহ্বান জানায় বেশ কয়েকটি দল।
এদিকে জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না দিলে সই করবে না তার দল। বরং উল্টো কমিশনের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলা করবে জামায়াত। এনসিপি সদস্য সচিব বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এখনও পর্যন্ত অস্পষ্ট।’
সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক সম্মতি আইনের উর্ধ্বে বলে জানান বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ।
বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শতভাগের কাছাকাছি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে বিএনপি, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে প্রয়োজনে গেজেট করা যেতে পারে।’
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ‘সরকার এখানে বৈধ ভিত্তি দেয়ার জন্য আন্তরিকতার পরিচয় দেবে এবং সে হিসেবেই তারা উদ্যোগ গ্রহণ করবে। আর এ বিষয়ে কোনো গরিমসি হলে বোঝা যাবে যে, এর মধ্যে ষড়যন্ত্র আছে।’
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘আমরা একটা অস্পষ্টতা দেখেছি এবং মনে হয়েছে কোনো একটা জায়গায় বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে কোনো একটা দুর্বলতা কাজ করছে। সে বিষয়গুলোতে যদি আমরা আলাপ আলোচনা করার পরে, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেই যদি হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই, তাহলে আমাদের সমস্ত চেষ্টা, পরিশ্রম এবং শহিদদের যে আত্মত্যাগ সেটা বিফলে যাবে।’
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান ভুঁইয়া মঞ্জু বলেন, ‘যদি কেউ এখানে কোনো ছলচাতুরি করার চেষ্টা করে, ইনশাআল্লাহ আমরা এটা রাজনৈতিকভাবে জনমত গড়ে তোলার মাধ্যমে, আমাদের সেই প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ হতে দেবো না।’
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা সই করবো, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা সই করবেন, অন্যান্যকমিশনের সদস্যগণ সই করবেন, ঐকমত্যে আসা দলগুলো সই করবেন। এর চেয়ে বড় জাতীয় সম্মতি, এটা তো আইনের উর্ধ্বে, এটা তো জনগণের অভিপ্রায়, এটা অনেকটা সার্বভৌম ব্যাপারের কাছাকাছি হয়ে গেলো। এটাকে যদি আমরা আইনি ভিত্তি না বলি, কোনটাকে বলবো?’
এদিকে বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে বৈঠকের সমাপ্তি ঘোষণা দিয়ে ড. আলী রীয়াজ জানালেন, নোট অব ডিসেন্টসহ ১৯টি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে।
ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘যেকোনো প্রক্রিয়াতে এগুলো বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট পথ-পদ্ধতি চিহ্নিত করতে হবে। সে প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর আগ্রহ আছে, আন্তরিকতা আছে। আমরা অনুরোধ করেছি যে, তারা নিজেদের মধ্যেও আলাপ আলোচনা অব্যাহত রাখুক। আমরা অনুঘণ্টকের দায়িত্ব পালন করবো।’
পরবর্তীতে আলোচনা হবে বাস্তবায়ন নিয়ে, কয়েকদিনের মধ্যে জাতীয় সনদের পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়া হবে বলেও জানান কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ।