অবহেলায় পাঠাগার: ২০ বছরেও পৌঁছায়নি একটি পত্রিকা, অথচ ঘাটতি নেই বাজেটে

অবহেলিত লাইব্রেরির চিত্র
অবহেলিত লাইব্রেরির চিত্র | ছবি: এখন টিভি
1

পাঠাগারের অস্তিত্ব না থাকলেও রয়েছে মোটা অংকের বাজেট। আবার কোথাও বরাদ্দের সাথে বাস্তব চিত্রের যোজন যোজন ব্যবধান। যেখানে ২০ বছরেও পৌঁছায়নি একটি পত্রিকার কপি। দায়িত্বরত কর্মকর্তাও জানেন না তার পাঠাগারের সঠিক সংখ্যা। অন্যদিকে লাইব্রেরি পরিচালনা নয় বরং বাজেট খরচ করাই আসল উদ্দেশ্য বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। দুই সিটি করপোরেশনের পাঠাগারগুলোর অব্যবস্থাপনার খবর জানা যাবে আজকের এই প্রতিবেদনে।

পাঠাগার আছে কিন্তু পাঠক নেই, আবার কোথাও পাঠক আছে কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী বই নেই। এমনি দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে নগরীর বেশিরভাগ গ্রন্থাগার। উন্নত মানসিকতা ও বুদ্ধিদীপ্ততার চর্চায় যেখানে লাইব্রেরির গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি, সেখানে কেন এমন ভগ্নদশা? আর কেনই বা বছরের পর বছর বরাদ্দ দিয়েও পাল্টানো যাচ্ছে না এমন চিত্র? আর বিষয়টির তদারকি ও পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন তাদের দায়সারা বক্তব্য কীসের ইঙ্গিত বহন করছে? তা তুলে ধরবে এখন টেলিভিশন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের চাননি ঘাট এলাকার মাওলানা মুফতি দ্বীন মোহাম্মদ ইসলামী পাঠাগার। বাইরে সাইনবোর্ড নেই, দেয়ালে ফাটল। দেখেই মনে হবে একটি পরিত্যক্ত ভবন। দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকার কথা থাকলেও বিকেল সোয়া ৫টায়ও মূল ফটকে তালা। আবার এখান থেকেই নাকি দেয়া হয় টিসিবির পণ্য।

স্থানীয়দের মধ্যে একজন বলেন, ‘মাসে দুই তিনবার খোলা হয়। কিন্তু তার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই।’

অন্য একজন বলেন, ‘আগে কেয়ারটেকার ছিল, এখন তো কেয়ারটেকারও দেখি না। ২০ বছর আগে পাঠাগার ছিল, এখন হয়ে গেছে ছাগলের ঘর। এখন পাঠাগার করার কোনো পরিবেশ নেই।’

সূত্রাপুরের জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র পাঠাগারও পাঠকশূন্য। শোকেসে সাজিয়ে রাখা বইগুলোও ২০ বছরের পুরানো। গ্রন্থাগারিক জানালেন, ২০০৬ সালের পর কোনো পত্রিকা আসনি পাঠাগারে। মাসে এক টাকাও সহায়তা পান না বলে জানান এই কর্মকর্তা। এমনকি সহায়তার জন্য চাহিদাপত্র পাঠানো হলেও, সাড়া মেলেনি কর্তৃপক্ষের।

গ্রন্থাগারিক মো. শরাফউদ্দিন বলেন, ‘জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র লাইব্রেরির জন্য দৈনিক পত্রিকা প্রসঙ্গে এই যে, মন চাহিদাপত্র দিতে দিতে আমি শেষ। ২০০৬ সাল থেকে ২০২৫ মানে ১৯ বছর। এই ১৯ বছরে আমি মাত্র ১২৬টা বই পেয়েছি।’

দক্ষিণ সিটির ওয়েবসাইট অবশ্য বলছে, তাদের তত্ত্বাবধানে থাকা আটটি পাঠাগারে গত আট অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকা। তাহলে এই অর্থের গন্তব্য কোথায়?

তা জানতেই গন্তব্য নগর ভবন। তবে তথ্যে অসঙ্গতি আর দায়সারা বক্তব্য দায়িত্বরতদের। দুই কর্মকর্তার কেউই জানেন না নগরে পাঠাগারের সংখ্যা কত।

ডিএসসিসি সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা (অ.দা.) মশিউর রহমান বলেন, ‘সবগুলোতে লাইব্রেরি নাই। চারে আর তিনে এই দুইটিতে লাইব্রেরি আছে।’

প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তিউন্নয়ন কর্মকর্তা মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘কাগজে কলমে অনকে পাঠাগার আছে, বাস্তবে কিছু নাই। কারণ পাঠাগারে কেউ যায় না।’

প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তিউন্নয়ন কর্মকর্তা মোবাশ্বের হোসেন জানান, পাঠাগার কাগজে কলমে তার অধীনে থাকলেও বাস্তবে কিছুই নেই। কারণ মানুষ নাকি আর সেখানে যায় না। উল্টো লাইব্রেরিগুলোর রুগ্নদশার দায় চাপিয়ে দিলেন গণগ্রন্থাগারের ওপর।

প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তিউন্নয়ন কর্মকর্তা মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘ঢাকা সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব শুধু পাঠাগার করা না। পাঠাগারের দায়িত্ব কার? গণগ্রন্থাগারের। তার জন্য আলাদা একটা সংস্থা করা হয়েছে। আমি আসলে একটা পাঠাগার নীতিমালা করতে চাই, বাংলাদেশে নাই।’

মোবাশ্বের হোসেনের এই দাবির অসারোতা ফুটে উঠলো গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের উপ-পরিচালকের কথায়।

গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের উপ-পরিচালকে এ. এইচ. এম কামরুজ্জামান বলেন, ‘আমার মতামত আমি বলে ফেলেছি আরকি। এটা তাদেরই এখতিয়ার। এটা সত্য নয়। আমি তো বিস্তারিত বুঝিয়ে দিয়েছি। এটা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অধিদপ্তরের আওতায়।’

দক্ষিণের চেয়েও নাজুক উত্তর সিটির চিত্র, পুরো এলাকা ঘুরেও কোনো লাইব্রেরির সন্ধান মেলেনি। সংশ্লিষ্ট সূত্র অনুযায়ী এখানে একটি পাঠাগারেরও অস্তিত্ব নেই। অথচ গ্রন্থাগার খাতে চলতি অর্থবছরে প্রায় সোয়া দুই কোটিসহ শেষ ১০ বছরে বরাদ্দ দেয়া হয় ১৯ কোটি টাকার বেশি।

সঠিক জবাবদিহিতার অভাবেই পাঠাগারের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক। তার মতে, উন্নয়ন নয় বাজেট খরচ করাই প্রধান উদ্দেশ্য, যাতে আদতে তছরুপ হচ্ছে রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘সিটি করপোরেশন যখন দায়হীন দায়িত্ব পালন করে বা এই জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে যখন যথেষ্ট ঘাটতি থাকে এবং এই ঘাটতির মধ্য দিয়ে পাঠাগারকে টিকিয়ে রেখে বাজেট অন্যায়ভাবে বা নিয়মবহির্ভূতভাবে খরচ করার অবস্থাগুলো দাঁড়িয়েছে এক্ষেত্রে যথেষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। আসলে পাঠাগারকে ধরে রেখে সেখান থেকে বাজেট জুচ্চুরি করা বা বাজেট আত্মসাৎ করার জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’

তরুণ প্রজন্মের মুঠোফোন আসক্তি, পাঠে অনভ্যাস ও পাঠক খরার উদাহরণ দিলেও বাজেটের যথাযথ ব্যয়ের ব্যর্থতা বা দায়িত্বে অবহেলার দায় কী এড়াতে পারে সিটি করপোরেশন?

এসএস