বর্ষার ভয়ংকর রূপ: দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বন্যা ও ভূমিধসের তাণ্ডব

ভারতের বন্যা পরিস্তিতির অবনতি
ভারতের বন্যা পরিস্তিতির অবনতি | ছবি: সংগৃহীত
0

বর্ষার ভয়ংকর রূপ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। ভারতের হিমাচলে বিধ্বংসী বন্যা-ভূমিধসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯১ জনে। পাকিস্তানের লাহোরে ভারী বৃষ্টিতে প্রাণ গেছে কমপক্ষে পাঁচজনের। চলতি মৌসুমে দেশটিতে প্রাণহানি অন্তত ৮৫। নেপালে বন্যার তিনদিন পরও বহির্বিশ্ব থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন সিল্ক রোডের রাসুওয়াগাঢি-তিমুর সড়ক। বন্যার কারণ— তিব্বতে হিমবাহ ধস। আবহাওয়া বিরূপ চীন আর জাপানেও।

তীব্র গরমের মধ্যে এক পশলা বৃষ্টিতে একটু স্বস্তি, তারপরই আর নাম নেই বৃষ্টি থামার। দিল্লি আর সংলগ্ন এলাকাগুলোতে টানা ভারী বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত জনজীবন। জলবদ্ধতার কবলে গুরুগ্রাম, ফরিদাবাদ, গাজিয়াবাদ, নয়ডা।

দিল্লির পাশাপাশি ভারী বৃষ্টির আভাস উত্তর প্রদেশের কিছু জেলা, পাঞ্জাবের উত্তর, হরিয়ানার উত্তর, মধ্য প্রদেশের পশ্চিম, গুজরাট, মধ্য মহারাষ্ট্র, কেরালা, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ আর উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে। কর্ণাটক ও গোয়ার উপকূলীয় অঞ্চল, উত্তরাখান্ড, হিমাচল প্রদেশ আর জম্মু-কাশ্মীরেও বিচ্ছিন্ন ভারী বৃষ্টির আভাস রয়েছে।

ভারী বৃষ্টিতে জম্মু-কাশ্মীরের চেনাব নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় খুলে দেয়া হয়েছে সালাল বাঁধের কয়েকটি গেট। নদীর তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের দূরে সরে যেতে বলা হয়েছে। অন্যদিকে হিমাচল প্রদেশে পাহাড়ি ঢল আর ভূমিধসে প্রাণহানি বাড়ছেই।

সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মান্ডিতে দুর্যোগিকবলিত মানুষের সহায়তায় প্রশাসনের সাথে সমন্বিতভাবে খাবারের ব্যবস্থা করছে এলাকাবাসী। ২০ জুন থেকে বিপর্যয়ের শুরু, চলতি সপ্তাহেও রাজ্যটিতে বৃষ্টি থামার আভাস নেই। বরং আগামী মঙ্গল বা বুধবার পর্যন্ত ভারী বৃষ্টির শঙ্কায় রাজ্যজুড়ে জারি ইয়েলো অ্যালার্ট, ছয় জেলায় বন্যা সতর্কতা।

স্থানীয়দের মধ্যে একজন বলেন, ‘এমন বন্যা না কখনো আমি দেখেছি, না কখনো এমন বন্যা হয়েছে। আমার বাপ-দাদাও এখানে থাকতেন, মারা গেছেন এখানেই, তারাও কখনো এমন বন্যা দেখেননি। এবার এমন বন্যাই এলো যে দেখার মতো কিছু রাখেনি।’

আরেকজন বলেন, ‘পরিস্থিতি এতো খারাপ যে স্থানীয়রা অনেক কষ্টে আছে। আমরা চাই যে প্রশাসন আমাদের কিছু সুযোগ-সুবিধা দিক। যাদের বাড়িঘর, ভেড়া-বাছুর সব চলে গেছে, যাদের জীবনই শেষ বলতে গেলে, তাদের যতভাবে সম্ভব সরকার সাহায্য করুক।’

গুজরাটে ভাদোদারা আর আনন্দর সংযোগ সেতু গম্ভীরা ধসের দু’দিনে বেড়েছে নিহতের সংখ্যা। এখনও চলছে সন্ধান ও উদ্ধার অভিযান। নিহতদের পরিবারকে দুই লাখ এবং আহতদের চিকিৎসায় ৫০ হাজার রুপি করে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার পর রাজ্যে ভারী বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট ও অন্যান্য স্থাপনা জরুরি মেরামতের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র প্যাটেল।

গুজরাটের উপনির্বাহী প্রকৌশলী বিবেক গিরি গোস্বামী বলেন, ‘গত ১৫ দিন ধরে অনেক বৃষ্টি হচ্ছিল। এখন বৃষ্টি একটু থেমেছে। বৃষ্টির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাটগুলো মেরামত করা দরকার ছিল। রাস্তায় হওয়া গর্তগুলো সারাতে ঠিকাদারদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।’

প্রতিবেশী নেপালেও চীনের সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় ভয়াবহ বন্যায় পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। রাসুওয়াগাঢি-তিমুর সড়ক বহির্বিশ্ব থেকে পুরোপুরো যোগাযোগবিচ্ছিন্ন। বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, টেলিফোন পরিষেবাও বিঘ্নিত। ১ হাজার ১০০ মিটার দীর্ঘ সড়কের ১০টি এলাকা, চারটি পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত।

ভুক্তভোগীদের মধ্যে একজন বলেন, ‘আমরা কোনো বন্যা সতর্কতা পাইনি। যখন হঠাৎ ঢল শুরু হলো, মনে হলো ভূমিকম্প হচ্ছে। দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। দেখি নদীতে দ্রুত পানি বাড়ছে।’

ভোটে কোশি নদীতে হঠাৎ পাহাড়ি ঢলে মঙ্গলবারের এমন বিধ্বংসী বন্যা। স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণের মাধ্যমে কাঠমান্ডুভিত্তিক একটি আঞ্চলিক জলবায়ু পর্যবেক্ষক সংস্থার তথ্য, তিব্বতের কিরং কাউন্টিতে হিমবাহ ধসের জেরে নেপালের ল্যাংটাং হিমাল রেঞ্জের উত্তরাঞ্চল হয়ে নেমে আসে ঢল।

পাকিস্তানেও আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ। লাহোরে অতিবৃষ্টি-জলাবদ্ধতায় হতাহত অর্ধশত মানুষ। টানা বৃষ্টিতে বিভিন্ন নদীতে পানি এবং উত্তরাঞ্চলে তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় শহর ও গ্রামাঞ্চলে বন্যা ও ভূমিধস সতর্কতা জারি রয়েছে। বিশেষ করে গিলগিত-বালতিস্তান ও খাইবার পাখতুনখোয়ায়। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুষলধারে বৃষ্টির আভাস দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে।

স্থানীয়দের মধ্যে একজন বলেন, ‘বৃষ্টি হলেই প্রশাসনের বিভিন্ন দল দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং যা যা করা দরকার, করছে। ভালোই কাজ হচ্ছে। আগে এই এলাকা দিনের পর দিন পানিতে ডুবে থাকতো। এখন বৃষ্টি থামলেই দ্রুত পানি নেমে যায়।’

অন্যদিকে ভয়াবহ বন্যার কবলে চীনের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চল। সিচুয়ান প্রদেশে ২৪ ঘণ্টায় ২১৮ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়। নিকটবর্তী শাঞ্জি নদীর তীর উপচে ভেসে গেছে কয়েকটি শহর। শাঞ্জি প্রদেশেও তীব্র স্রোতে ভেসে গেছে বিপুলসংখ্যক যানবাহন, সেতু, বাড়িঘর।

জাপানের রাজধানী টোকিওতে বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) সন্ধ্যা থেকে চলছে টানা বৃষ্টি। শুক্রবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেড়শো মিলিমিটার বৃষ্টির আভাস। বিপজ্জনকভাবে বেড়েছে মেগুরো নদীর পানি।

এসএইচ