দেখে যুদ্ধক্ষেত্র বলে মনে হলেও আদতে তা নয়। এটি গাজায় স্রেফ খাবার বিতরণের একটি কেন্দ্র। অভুক্ত মানুষ যখন একটু খাবারের অপেক্ষায়, তখনই মরুর বুকে গোলাগুলি আর আতঙ্কিত মানুষের গুলি থেকে বাঁচার চেষ্টা।
এটি উপত্যকার চারটি ত্রাণকেন্দ্রের একটি, যা পরিচালনা করছে তথাকথিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন জিএইচএফ। গাজার স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের হাতে ত্রাণ পৌঁছানো রুখতে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ উদ্যোগ এই জিএইচএফ; যে উদ্যোগ থেকে বেরিয়ে গেছে জাতিসংঘ।
বিবিসি'র ভিডিওটিতে জিএইচএফের সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীদের গুলিবর্ষণের চিত্র ধরা পড়ে। ভিডিও ধারণ করেন এক মার্কিন সেনা, যিনি বাহিনী থেকে অবসর নেয়ার পর গাজায় এ অভিযানে অংশ নেন। ইসরাইলি সেনা আর নিজের মার্কিন সহকর্মীদের গুলি চালিয়ে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করতে দেখে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন তিনি। জানান, ত্রাণের আশায় হাত বাড়িয়ে থাকা নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর চলমান নজিরবিহীন বর্বরতার সাক্ষী তিনি নিজে।
মার্কিন বিশেষ বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা অ্যান্থনি আগুইলার বলেন, ‘ইসরাইলি সেনাবাহিনী কীভাবে মার্কাভা ট্যাংক থেকে সাধারণ মানুষের ভিড় লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করেছে, আমি তার সাক্ষী। একটা গাড়ি উড়িয়ে দিয়েছে, যেখানে সাধারণ বেসামরিক মানুষজন ছিল, যারা কেবল ঘটনাস্থল থেকে দূরে সরে যেতে চেয়েছিল। ভিড় নিয়ন্ত্রণে কীভাবে মানুষের উপর গোলাবর্ষণ করা হয়েছে, সবকিছুর সাক্ষী হয়েছি আমি।’
যুদ্ধের প্রায় দুই বছরে গাজায় ফিলিস্তিনি নিহতের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, কমপক্ষে ১০১ ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে অনাহারে, অপুষ্টিতে, যাদের মধ্যে ৮০ জনই শিশু। আর ২১ জুলাই পর্যন্ত ত্রাণের খাবার নিতে গিয়ে ইসরাইলি সেনাদের গুলিতে প্রাণ গেছে এক হাজার ৫৪ জনের।
অ্যান্থনি আগুইলার বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমি বলবো, ত্রাণকেন্দ্রগুলো পরিচালিত হচ্ছে চরম অপেশাদারভাবে, কোনোরকম অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই। কোনো ধারণাই নেই তাদের যে এতো বড় কোনো কর্মযজ্ঞ কীভাবে পরিচালনা করতে হয়। সবচেয়ে নমনীয়ভাবে বলছি এটা। আর সৎভাবে বলতে হলে বলবো যে ওরা অপরাধী। আমার পুরো কর্মজীবনে আমি কখনোই এমন নিষ্ঠুরতা দেখিনি, যেখানে বেসামরিক এবং নিরস্ত্র, ক্ষুধার্ত মানুষের বিরুদ্ধে এভাবে অপ্রয়োজনীয় ও নির্বিচার শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে। আমি বিশ্বের বহু সংঘাতপূর্ণ স্থানে কাজ করেছি। কিন্তু গাজায় ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং মার্কিন ঠিকাদারদের সাথে কাজ করার আগে এমন নিষ্ঠুরতা আমি কোথাও দেখিনি।’
গাজায় সীমাহীন যুদ্ধাপরাধের দামামা সারা বিশ্বে বেজে চললেও কোনোভাবেই তা মানতে রাজি নয় ইসরাইলি দখলদাররা। ইসরাইলের ঘনিষ্ঠতম দেশ যুক্তরাষ্ট্রের এই সেনা কর্মকর্তা যখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে একই অভিযোগ করেন, তখন কীভাবে সাফাই গাইবে যুদ্ধবাজ দেশটি?
মার্কিন বিশেষ বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এ সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই যে আমি যুদ্ধাপরাধের সাক্ষী। আমি ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর যুদ্ধাপরাধ নিজ চোখে দেখেছি। নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষকে লক্ষ্য করে গোলাগুলি ও বোমাবর্ষণ করতে দেখেছি। এই যুদ্ধাপরাধ নিয়ে কোনো প্রশ্নের সুযোগ নেই।’
ক্ষুধা সহ্যের ক্ষমতা মানুষের কতোটুকু? শেষ পর্যন্ত শক্তি হারিয়ে ঢলে পড়তে হয় মৃত্যুর কোলেই। আর এটাই এখন সবচেয়ে বড় বাস্তবতা গাজার। নিরস্ত্র মানুষকে লক্ষ্য করে গুলি চলছে না বলে ইসরাইলি সেনাবাহিনী দাবি করলেও, যখন প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য উঠে আসছে এবং উল্লেখযোগ্য প্রমাণের পাল্লা ভারী হচ্ছে, তাতে স্পষ্ট যে নিরস্ত্র মানুষ হত্যার কাজটি ইসরাইলি সেনারা নিয়মিতই করে থাকে।