অন্তর্বর্তী সরকারের ১ বছর; প্রত্যাশা পূরণের নাকি ব্যর্থতার?

অন্তর্বতী সরকারের সপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের ছবি
অন্তর্বতী সরকারের সপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের ছবি | ছবি: এখন টিভি
0

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী ঘটনাবহুল এক বছর পার করলো অন্তর্বর্তী সরকার। নানা ষড়যন্ত্র আর দাবি-আন্দোলনের মুখে কতটা অর্জন তাদের? সরকারের পক্ষে সফলতার গল্প তুলে ধরা হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মন্তব্য, আশার ঝুলি পূর্ণ করতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। আর বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন ঘটানোর পাশাপাশি সুষ্ঠু নির্বাচন দেয়াই সরকারের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ।

ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থান, রাজপথের লড়াই-সংগ্রাম আর হাজারো প্রাণের বিনিময়ে পতন হয় আওয়ামী লীগের। ’২৪-এর জুলাই আন্দোলনের হাত ধরে ক্ষমতার মসনদ ছেড়ে দেশত্যাগে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দেশের রাজনীতির অধ্যায়ে লেখা হয় নতুন এক ইতিহাস।

এরপর ৮ আগস্ট বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কাছে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শপথ নেয় ১৩ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ।

জগদ্দল পাথর নেমে যাওয়ার পর মানুষের আশা-ভরসার আশ্রয় হয়ে ওঠে ইউনূস সরকার। কেমন ছিল এই সরকারের এক বছরের কার্যক্রম? নানা চ্যালেঞ্জের মুখে এক বর্ষপঞ্জিকায় সফলতা নাকি ব্যর্থতা— কোন পাল্লা ভারী ছিল?

অভ্যুত্থান পরবর্তী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, মব নিয়ন্ত্রণ, মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা, ভঙ্গুর অর্থনৈতিক কাঠামোকে মজবুত করাই যেন প্রধানতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় সরকারের সামনে। কিন্তু সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো বারবার অভিযোগ তুলেছেন, পতিত সরকারের একের পর এক ষড়যন্ত্রে কণ্টকাকীর্ণ হয় ৫ আগস্ট পরবর্তী অধ্যায়।

আরও পড়ুন:

শপথের দু’দিন পরেই সরকারের সামনে আসতে থাকে নানামুখী চ্যালেঞ্জ। ১০ আগস্ট অনেকটা তাড়াহুড়ো আর লুকোচুরি করে ডাকা হয় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিয়ে ফুল কোর্ট মিটিং। 

‘জুডিশিয়াল ক্যু’ নিয়ে সন্দেহের দানা বাঁধলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ে। তাৎক্ষণিক এ ষড়যন্ত্র রুখে দেয় সরকার।

এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২৫ আগস্ট শুরু হয় আনসার বাহিনীর বিক্ষোভ। চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে সচিবালয় ঘেরাও করে আন্দোলন করে বাহিনীর একটি অংশ, যা সফলভাবে সামাল দেয় সরকার।

এক বছর পূর্তিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের সফলতার কথা তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব। যেখানে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, বাণিজ্য অগ্রগতি, জুলাই সনদ, জুলাই হত্যাযজ্ঞের বিচার, প্রবাসী অধিকার, পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তনসহ ১২টি বিষয় তুলে ধরা হয়।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘আজকে থেকে দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরু এবং তিনি বলেছেন, এই অধ্যায়ের প্রথম এবং প্রধান কাজ হচ্ছে নির্বাচন সুন্দরভাবে করা। ইউএস আমাদের ওপর ২০ শতাংশ শুল্কারোপ করেছে। এটা সত্যিকার অর্থে আমাদের যারা কম্পিটিটর, তাদের থেকে ভালো অথবা তাদের সঙ্গে একই অবস্থানে আছি।’

এখন পর্যন্ত সরকারের অন্যতম সফলতা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। উত্তরাধিকার সূত্রে দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আর বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেও সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে কমিয়ে আনতে সমর্থ হয় সরকার। সবশেষ মার্কিন শুল্কও কমিয়ে আনে।

তলানিতে থাকা রিজার্ভও চাঙ্গা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের হাত ধরে। এখন পর্যন্ত ছাড়িয়েছে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর গত এক বছরে রেমিটান্সের মাধ্যমে দেশে আসে রেকর্ড ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। তবে বৈদেশিক বিনিয়োগ আর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আশার আলো জ্বালতে ব্যর্থ সরকার।

এক বছরে নানা ইন্ধনে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিব্রত করার পাঁয়তারার অভিযোগ আছে বিস্তর। এর মাঝেই দেশজুড়ে ডানা মেলতে থাকে মব সংস্কৃতি। বাড়ে ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম, যা ঠেকাতে হিমশিম খায় সরকার।

এছাড়া নির্বাচন, সংবিধান, স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম সংস্কারে গঠন করা ছয়টি কমিশনের অধিকাংশ সুপারিশই এখনো পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি।

রাষ্ট্রচিন্তক ও গবেষক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, ‘ছয়টি কমিটি করেছেন তারা রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের জন্য। সেই সংস্কারগুলো দরকারি। কিন্তু কোনোটিই তো একটু বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে তারা বলেনি। যতটা পারা যায়, জাতীয় সনদের একটা নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে এ সরকার যদি চলে যায়, সেটা ভালো। দেশের জন্য ভালো কাজ ক্ষমতার বাইরে থাকলেও করা যায়।’

এক বছরের মাথায় জুলাই ঘোষণাপত্র দেয়াকে ইতিবাচক বলছেন অনেকেই। তবে এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে।

ঘোষণাপত্রকে স্বাগত জানালেও বিএনপি বলছে, এক বছরে আশানুরূপ প্রতিদান দিতে পারেনি সরকার। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ ড. ইউনূসের সরকার।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এ সরকারে যারাই আছে, তাদের আসলে রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা খুব কম ব্যক্তিরই আছে। তাদের প্রতি জাতির প্রত্যাশা একটু বেশিই ছিল।’

তবে জামায়াতে ইসলামীর মত, জুলাই ঘোষণাপত্র অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। সংস্কার ইস্যুতেও সরকারের ধীরগতির অভিযোগ দলটির।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘প্রত্যাশা আমাদের অনেকই ছিল, আসলে সেই প্রত্যাশা শতভাগ পূর্ণ হয়নি। এখনও দুর্নীতি আছে, এখনও সন্ত্রাস-মব জাস্টিস আছে, চাঁদাবাজি আছে। আইনি ভিত্তি দিয়ে, জুলাই চার্টারকে আইনে পরিণত করে আগামী নির্বাচন করতে পারলে আমাদের প্রত্যাশা অনেকাংশে পূরণ হবে।’

ফ্যাসিবাদ পতনের পর যে নতুন সম্ভাবনা আর সংস্কারের প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি, অনিশ্চয়তা কাটিয়ে তা কতটা বাস্তবায়নযোগ্য? সে প্রশ্নের সমাধান হোক বা না হোক, অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায়ের যাত্রাপথে এখন বড় চ্যালেঞ্জ আগামী নির্বাচন।

এসএইচ